সাগর। কেন মা?
ষোড়শী। তাঁকে আমার বড় প্রয়োজন। তোরা ছাড়া তাঁর চেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী আমার কেউ নেই।
সাগর। কিন্তু তোমার কাছেই ত কতবার শুনেছি তিনি সাধুপুরুষ। যেখানেই থাকুন তাঁকে যথার্থ মন দিয়ে ডাকলেই এসে উপস্থিত হন।
ষোড়শী। (চমকিয়া) তাই ত সাগর, এতবড় কথাটা আমি কি করে ভুলেছিলাম! আর আমার চিন্তা নেই, আমার এতবড় দুঃসময়ে তিনি না এসে কিছুতেই পারবেন না।
সাগর। আমারও বিশ্বাস তাই। কিন্তু কথায় কথায় রাত্রি অনেক হলো মা, তুমি বিশ্রাম কর, আসি?
ষোড়শী। এসো।
সাগর। (ঈষৎ হাসিয়া) ভয় নেই মা, সাগর তোমাকে একলা রেখে কোথাও বেশীক্ষণ থাকবে না।
[প্রস্থান
[তখন পর্যন্ত ষোড়শীর আহ্নিক প্রভৃতি নিত্যকার্য সমাধা হয় নাই, সে এই আয়োজনে ব্যাপৃত থাকিয়া]
ষোড়শী। সাগর আমাকে কতবড় কথাই না স্মরণ করিয়ে দিলে। ফকির-সাহেব! যেখানে থাকুন, এ বিপদে আপনার দেখা আমি পাবোই পাব।
নেপথ্যে। আসতে পারি কি?
ষোড়শী। (সচকিত উঠিয়া দাঁড়াইয়া ব্যাকুল-কণ্ঠে) আসুন, আসুন—আমি যে সমস্ত মন দিয়ে শুধু আপনাকেই ডাকছিলাম!
[জীবানন্দ প্রবেশ করিলেন]
জীবানন্দ। এতবড় পতিভক্তি কলিকালে দুর্লভ। আমার পাদ্য অর্ঘ্য আসনাদি কৈ?
ষোড়শী। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া, সভয়ে) আপনি? আপনি এসেছেন কেন?
জীবানন্দ। তোমাকে দেখতে। একটু ভয় পেয়েছ বোধ হচ্ছে। পাবারই কথা। কিন্তু চেঁচিও না। সঙ্গে পিস্তল আছে, তোমার ডাকাতের দল শুধু মারাই পড়বে, আর বিশেষ কিছু করতে পারবে না।
[ষোড়শী নির্বাক হইয়া রহিল]
জীবানন্দ। তবু, দোরটা বন্ধ করে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যাক। কি বল?
[এই বলিয়া জীবানন্দ অগ্রসর হইয়া দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া দিলেন]
ষোড়শী। (ভয়ে কণ্ঠস্বর তাহার কাঁপিতেছিল) সাগর নেই—
জীবানন্দ। নেই? ব্যাটা গেল কোথায়?
ষোড়শী। আপনারা জানেন বলেই ত—
জীবানন্দ। জানি বলে? কিন্তু আপনারা কারা? আমি ত বাষ্পও জানতাম না।
ষোড়শী। নিরাশ্রয় বলেই ত লোক নিয়ে আমার প্রতি অত্যাচার করতে এসেছেন? কিন্তু আপনার কি করেছি আমি?
জীবানন্দ। লোক নিয়ে অত্যাচার করতে এসেছি? তোমার প্রতি? মাইরি না! বরঞ্চ মন কেমন করছিল বলে ছুটে দেখতে এসেছি।
[ষোড়শীর চোখে জল আসিতেছিল, এই উপহাসে তাহা একেবারে শুকাইয়া গেল। জীবানন্দ অদূরে বসিয়া তাহার আনত মুখের প্রতি লুব্ধ তৃষিত চক্ষে চাহিয়া রহিলেন]
জীবানন্দ। অলকা?
ষোড়শী। বলুন।
জীবানন্দ। তোমার এখানে তামাক-টামাকের ব্যবস্থা নেই বুঝি?
[ষোড়শী একবার মুখ তুলিয়াই অধোমুখে স্থির হইয়া রহিল]
জীবানন্দ। (দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া) ব্রজেশ্বরের কপাল ভাল ছিল। দেবীরানী তাকে ধরিয়ে আনিয়েছিল সত্যি, কিন্তু অম্বুরী তামাকও খাইয়েছিল, এবং ভোজনান্তে দক্ষিণাও দিয়েছিল। বিদায়ের পালাটা আর তুলব না, বলি বঙ্কিমবাবুর বইখানা পড়েছ ত?
ষোড়শী। আপনাকে ধরে আনলে সেইমত ব্যবস্থাও থাকত—অনুযোগ করতে হত না।
জীবানন্দ। (হাসিয়া) তা বটে। টানা-হেঁচড়া দড়িদড়ার বাঁধাবাঁধিই মানুষের নজরে পড়ে। ভোজপুরী পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে আনাটাই পাড়াসুদ্ধ সকলেই দেখে; কিন্তু যে পেয়াদাটিকে চোখে দেখা যায় না—হাঁ অলকা, তোমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে তাঁকে কি বলে? অতনু, না? বেশ তিনি। (ক্ষণেক নীরব থাকিয়া) যৎসামান্য অনুরোধ ছিল; কিন্তু আজ উঠি। তোমার অনুচরগুলো সন্ধান পেলেই জামাই আদর করবে না। এমন কি শ্বশুরবাড়ি এসেছি বলে হয়ত বিশ্বাস করতেই চাইবে না—ভাববে প্রাণের দায়ে বুঝি মিথ্যেই বলচি।
[লজ্জায় ষোড়শী আরও অবনত হইল]
জীবানন্দ। তামাকের ধুঁয়া আপাততঃ পেটে না গেলেও চলত, কিন্তু ধুঁয়া নয় এমন কিছু একটা পেটে না গেলে আর ত দাঁড়াতে পারিনে। বাস্তবিক, নেই কিছু অলকা?
ষোড়শী। কিছু কি? মদ?
জীবানন্দ। (হাসিয়া মাথা নাড়িয়া) এবারে ভুল হলো। ওর জন্যে অন্য লোক আছে, সে তুমি নয়। তোমাকে বুঝতে পারার যথেষ্ট সুবিধে দিয়েছ—আর যা অপবাদ দিই, অস্পষ্টতার অপবাদ দিতে পারব না। অতএব তোমার কাছে যদি চাইতেই হয়, চাই এমন কিছু যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, মরণের পথে ঠেলে দেয় না। ডাল, ভাত, মেঠাইমণ্ডা, চিঁড়ে, মুড়ি যা হোক দাও, আমি খেয়ে বাঁচি। নেই?
[ষোড়শী নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া রহিল]
জীবানন্দ। আজ সকালে মন ভাল ছিল না। শরীরের কথা তোলা বিড়ম্বনা, কারণ সুস্থদেহ যে কি আমি জানিনে। সকালে হঠাৎ নদীর তীরে বেরিয়ে পড়লাম, কত যে হাঁটলাম বলতে পারিনে—ফিরতে ইচ্ছেও হলো না। সূর্যদেব অস্ত গেলেন, একলা জলের ধারে দাঁড়িয়ে কি যে ভাল লাগল বলতে পারিনে। কেবল তোমাকে মনে পড়তে লাগল। মনে পড়ল আমার কাছারি-বাড়িতে এতক্ষণে লোক জমেছে—তোমাকে নির্বাসনে পাঠাবার ব্যবস্থাটা আজ শেষ করাই চাই। ফিরে এসে সভায় যোগ দিলাম, কিন্তু টিকতে পারলাম না। একটা ছুতো করে পালিয়ে এসে দাঁড়ালাম ওই মনসা গাছটার পিছনে।
ষোড়শী। তার পরে?
জীবানন্দ। দেখি দাঁড়িয়ে সাগর সর্দার এবং তুমি। আলাপ-আলোচনা সমস্তই কানে গেল, তাৎপর্য গ্রহণ করতেও বিলম্ব হলো না। ভাবলাম, আমাদের মত সাধু ব্যক্তিরা যে এ-হেন নির্বোধ ভৈরবীকে দূর করে দিতে চেয়েছে সে ঠিকই হয়েছে। সে-রাত্রি বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ পেয়াদা হাতকড়া নিয়ে হাজির, সামান্য একটা মুখের কথার জন্য স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পর্যন্ত কি পীড়াপীড়ি—আর তুমি বললে কিনা আমি নিজের ইচ্ছায় এসেছি। আর ছোট্ট একটুখানি হুকুমের জন্যে সাগরচাঁদের কত অনুনয়-বিনয়, কি সাধাসাধি—আর তুমি বলে বসলে কিনা অমন কথা মুখেও আনিস নে বাবা। অভিমানে বাবাজীবন মুখখানি ম্লান করে চলে গেলেন সে ত স্বচক্ষেই দেখলাম। মনে মনে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বললাম, জয় মা চণ্ডীগড়ের চণ্ডী! তোমার এই অধম সন্তানের প্রতি এত কৃপা না থাকলে কি আর এই মেয়েমানুষটির বার বার এমন করে বুদ্ধি লোপ কর! এখন একবার একে বিদায় করে আমাকে তক্তে বসাও মা, জনার্দন আর এককড়ি, এই দুই তাল-বেতালকে সঙ্গে নিয়ে আমি এমনি সেবা তোমার শুরু করে দেব যে, একদিনের পূজোর চোটে তোমার মাটির মূর্তি আহ্লাদে একেবারে পাথর হয়ে যাবে। কিন্তু ভক্তি-তত্ত্বের এ-সব বড় বড় কথা না হয় পরে ভাবা যাবে, কিন্তু এখন ক্ষিদের জ্বালায় যে আর দাঁড়াতে পারিনে। বাস্তবিক নেই কিছু অলকা?