ষোড়শী। এর চেয়েও কত খারাপ ঘরে কত মানুষকে ত থাকতে হয় ভাই।
হৈম। তা হলে সত্যিই কি তুমি সব ছেড়ে দেবে?
নির্মল। তা ছাড়া কি উপায় আছে বলতে পার? সমস্ত গ্রামের সঙ্গে ত একজন অসহায় স্ত্রীলোক দিবানিশি বিবাদ করে টিকতে পারে না।
হৈম। আমরা সমস্তই শুনেছি। তুমি সন্ন্যাসিনী, সবই তোমার সইবে, কিন্তু এর সঙ্গে যে মিথ্যে দুর্নাম লেগে রইল সেও কি সইবে দিদি?
ষোড়শী। দুর্নাম যদি মিথ্যেই হয় সইবে না কেন? হৈম, সংসারে মিথ্যে কথার অভাব নেই, কিন্তু সেই মিথ্যে কথার সঙ্গে ঝগড়া করে মিথ্যে কাজের সৃষ্টি করতে আমার লজ্জা করে বোন।
হৈম। দিদি, তুমি সন্ন্যাসিনী, তোমার সব কথা আমরা বুঝতে পারিনে, কিন্তু তোমাকে দেখে কি আমার মনে হয় জানো? আমার শ্বশুরকে কোন্ এক রাজা একখানি তলোয়ার খিলাত দিয়েছিলেন। খাপখানা তার ধূলো-বালিতে মলিন হয়ে গেছে, কিন্তু আসল জিনিসে কোথাও এতটুকু ময়লা ধরেনি। সে যেমন সোজা, তেমন খাঁটি, তেমনি কঠিন। তার কথা আমার তোমার পানে চাইলেই মনে পড়ে। মনে হয় দেশসুদ্ধ লোকে সবাই ভুল করেছে, আসল কথা কেউ কিছুই জানে না।
ষোড়শী। (হৈমর হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া) আজ তোমাদের কেন যাওয়া হলো না হৈম? বোধ হয় কাল যাওয়া হবে, না?
হৈম। আমার ছেলের কথা তুললেই রাগ কর, সে আর বলব না, কিন্তু ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতে আমার এই অন্ধ মানুষটিকে যিনি হাতে ধরে নদী পার করে এনে নিঃশব্দে দিয়ে গেছেন, তাঁর পায়ের ধূলো না নিয়েই বা আমরা যাই কি করে? কিন্তু যাবার আগে এই কথাটি আজ দাও দিদি, আপনার লোকের যদি কখনো দরকার হয়, এই প্রবাসী বোনটিকে তখন ভুলো না।
হৈম। (ষোড়শীকে নীরব দেখিয়া) কথা দিতে বুঝি চাও না দিদি?
ষোড়শী। কথা দিলাম, ভুলব না। ভুলিওনি হৈম। আঘাত পেয়ে আজই তোমাকে একখানা চিঠি লিখছিলাম, ভেবেছিলাম, তুমি চলে গেলে সেখানা তোমাকে ডাকে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু শেষ করতে পারলাম না, হঠাৎ মনে পড়ল এর জন্যে হয়ত তোমার বাবার সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত বিবাদ বেধে যাবে।
হৈম। যেতেও পারে। কিন্তু আরও যে একটা মস্ত কথা আছে দিদি। আমার এই অন্ধ মানুষটিকে তুমি রক্ষে করেছ, তার চেয়ে বড় সংসারে ত আমার কিছুই নেই।
ষোড়শী। সত্যিই কিছু নেই হৈম?
হৈম। না, নেই। আর এই সত্যি কথাটিই বলে যাব বলে আজ যেতে পারিনি।
ষোড়শী। (হাসিয়া) কিন্তু এই ছোট্ট কথাটুকুর জন্যে ত একজনই যথেষ্ট ছিল ভাই, নির্মলবাবুকে ত অনায়াসে যেতে দিতে পারতে?
হৈম। এঁকে? একলা? হায়, হায়, দিদি, বাইরে থেকে তোমরা ভাব প্রচণ্ড ব্যারিস্টার, মস্তলোক। কিন্তু আমিই জানি শুধু এই বিনি-মাইনের দাসীটিকে পেয়েছিলেন বলেই উনি জগতে টিকে গেলেন। বাস্তবিক দিদি, পুরুষমানুষদের এই এক আশ্চর্য ব্যাপার। বাইরের দিকে যিনি যত বড়, যত দুর্দম, যত শক্তিমান, ভিতরের দিকে তিনি তেমনি অক্ষম, তেমনি দুর্বল, তেমনি অপটু। দরকারের সময় কোথায় হারাবে এঁদের কাগজপত্র, বার হবার সময়ে কোথায় যাবে জামা-কাপড়-পোশাক, রাস্তায় বেরিয়ে কোথায় ফেলবে পকেটের টাকাকড়ি—কোন্ ভরসায় একলা ছেড়ে দিই বল ত? (সহাস্যে) একটুখানি চোখের আড়াল করেছিলাম বলেই ত সেদিন অমন বিভ্রাট বাধিয়েছিলেন। ভাগ্যে তুমি ছিলে!
ভৃত্য। মা, কালকের মত আজও ঝড়-জল হতে পারে—মেঘ উঠেচে।
হৈম। আজ তা হলে উঠি। মেঘের জন্যে নয় দিদি, তোমার কাছ থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কাল সকালেই যাত্রা করতে হবে—আজ যেন আর কাজের অন্ত নেই। এঁকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি, লুকিয়ে বাড়ি ঢুকতে হবে—বাবা না দেখতে পান। এতক্ষণে খোকা হয়ত ঘুম ভেঙ্গে বসে কাঁদচে, তাকে আবার দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হবে, এঁর খাওয়া-দাওয়া আমি ছাড়া আর কেউ বোঝে না, আড়ালে থেকে সে ব্যবস্থা করতে হবে—তার পরে রেলগাড়িতে দীর্ঘ পথের সমস্ত আয়োজনই আমাকে নিজের হাতে করে নিতে হবে। কারও উপর নির্ভর করবার জো নেই। স্বামী, পুত্র, চাকর-বাকর—তার কত ঝঞ্ঝাট, কত ভার—আমার নিঃশ্বাস ফেলবারও সময় নেই দিদি।
ষোড়শী। এতে ত তোমার কষ্ট হয় বোন?
হৈম। (হাসিমুখে) তা হয়। তবু এই আশীর্বাদ আমাকে কর তুমি, যেন এই কষ্ট মাথায় নিয়েই একদিন যেতে পারি। আর ফিরে যদি আবার জন্ম নিতেই হয়, যেন এমনি কষ্টই বিধাতা আমার অদৃষ্টে লিখে দেন। সেদিনও যেন এমনি নিঃশ্বাস ফেলবারও অবকাশ না পাই।
ষোড়শী। তোমার কথাটা আমি বুঝেচি হৈম। এ যেন তোমার আনন্দের মধুচক্র। ভার যতই বাড়চে ততই এর রন্ধ্র মধুতে ভরে ভরে উঠচে। তাই হোক, এই আশীর্বাদই তোমাকে আজ করি।
হৈম। (সহসা পদধূলি লইয়া) তাই কর দিদি, মেয়েমানুষের জীবনের এর বড় আশীর্বাদ কি আছে!
নির্মল। আঃ, কি বকে যাচ্চো বল ত? আজ তোমার হলো কি?
হৈম। কি যে হয়েছে তুমি তার জানবে কি?
ষোড়শী। জানার শক্তিই আছে নাকি আপনাদের?
নির্মল। আপনাদের অর্থাৎ পুরুষদের ত? না, এতবড় কঠিন তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করবার সাধ্য নেই আমাদের সে কথা মানি, কিন্তু আপনিই বা এ সত্য জানলেন কি করে?
হৈম। কেন? দেবীর ভৈরবী বলে? কিন্তু ভৈরবী কি নারী নয়? ওগো মশায়, এ তত্ত্ব আমাদের চেষ্টা করে শিখতে হয় না। আমাদের জন্মকালে বিধাতা স্বহস্তে তাঁর দুই হাত পূর্ণ করে আমাদের বুকের মধ্যে ঢেলে দেন। সে সম্পদের কাছে ইন্দ্রাণীর ঐশ্বর্যও কামনা করিনে এ কি সত্যি নয় দিদি?