জনার্দন। আপনি কি ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?
শিরোমণি। না না, ভয় নয়,—কিন্তু তুমিও যে খুব ভরসা পেলে তা ত তোমারও মুখ দেখে অনুভব হচ্ছে না। হুজুরটি ত কানকাটা সেপাই—কথাও যেমন হেঁয়ালি, কাজও তেমনি অদ্ভুত। ও যে ধরে গলা টিপে মদ খাইয়ে দেয়নি এই আশ্চর্য। এককড়ির মুখে ভৈরবী ঠাকরুনের হুমকিও ত শুনলে? তোমরা চুপ করে ছিলে, আমিই মেলা কথা কয়েছি—ভাল করিনি। কি জানি, এককোড়ে ব্যাটা ভেতরে ভেতরে সব বলে দেয় নাকি। দুয়ের মাঝখানে পড়ে শেষকালে না বেড়াজালে ধরা পড়ি।
জনার্দন। (উদাস-কণ্ঠে) সকলই চণ্ডীর ইচ্ছে। বেলা হলো, সন্ধ্যের পর একবার আসবেন।
শিরোমণি। তা আসব। কিন্তু ঐ যে আবার এঁরা ফিরে আসচেন হে!
[মন্দির-প্রাঙ্গণের একটা দ্বার দিয়া ষোড়শী ও তাহার পশ্চাতে সাগর ও তাহার সঙ্গী প্রবেশ করিল। অন্য দ্বার দিয়া জীবানন্দ, প্রফুল্ল, ভৃত্য ও কয়েকজন পাইক প্রবেশ করিল]
জীবানন্দ। চলে যাচ্ছিলাম, শুধু তোমাকে আসতে দেখে ফিরে এলাম। এককড়িকে দিয়ে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম এবং তারই মুখে তোমার জবাবও শুনলাম। তোমার বিরুদ্ধে রাজার আদালতে গিয়ে দাঁড়াবার বুদ্ধি আমার নেই, কিন্তু নিজের প্রজাদের শাসনে রাখবার বিদ্যেও জানি। সমস্ত গ্রামের প্রার্থনা-মত তোমার সম্বন্ধে কি আদেশ করেছি শুনেছ?
ষোড়শী। না।
জীবানন্দ। তোমাকে বিদায় করা হয়েছে। নতুন ভৈরবী করে, তাকে মন্দিরের ভার দেওয়া হবে। অভিষেকের দিনও স্থির হয়ে গেছে। তুমি রায়মশায় প্রভৃতির হাতে দেবীর সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে আমার গোমস্তার হাতে সিন্দুকের চাবি দেবে। এ বিষয়ে তোমার কিছু বলবার আছে?
ষোড়শী। আমার বক্তব্যে আপনার কি কিছু প্রয়োজন আছে?
জীবানন্দ। না, নেই। তবে আজ সন্ধ্যার পরে এইখানেই একটা সভা হবে। ইচ্ছে কর ত দশের সামনে তোমার দুঃখ জানাতে পার। ভালো কথা, শুনতে পেলাম আমার বিরুদ্ধে আমার প্রজাদের নাকি তুমি বিদ্রোহী করে তোলবার চেষ্টা করচ?
ষোড়শী। তা জানিনে। তবে আমার নিজের প্রজাদের আপনার উপদ্রব থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি।
জীবানন্দ। (অধর দংশন করিয়া) পারবে?
ষোড়শী। পারা না পারা মা-চণ্ডীর হাতে।
জীবানন্দ। তারা মরবে।
ষোড়শী। মানুষ অমর নয় সে তারা জানে।
[ক্রোধে ও অপমানে সকলের চোখ-মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল। এককড়ি এমন ভাব দেখাইতে লাগিল যে সে কষ্টে আপনাকে সংযত করিয়া রাখিয়াছে]
জীবানন্দ। (একমুহূর্ত স্তব্ধ থাকিয়া) তোমার নিজের প্রজা আজ কেউ নাই। তারা যাঁর প্রজা তিনি নিজে দস্তখত করে দিয়েছেন। তাঁকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
ষোড়শী। (মুখ তুলিয়া) আপনার আর কোন হুকুম আছে? নেই? তা হলে দয়া করে এইবার আমার কথাটা শুনুন।
জীবানন্দ। বল।
ষোড়শী। আজ দেবীর অস্থাবর সম্পত্তির বুঝিয়ে দেবার সময় আমার নেই, এই সন্ধ্যায় মন্দিরের কোথাও সভা-সমিতির স্থানও হবে না। এগুলো এখন বন্ধ রাখতে হবে।
শিরোমণি। (সহসা চিৎকার করিয়া) কখনো না! কিছুতেই নয়! এ-সব চালাকি আমাদের কাছে খাটবে না বলে দিচ্চি—
[জীবানন্দ ছাড়া সকলেই ইহার প্রতিধ্বনি করিয়া উঠিল]
জনার্দন। (উষ্মার সহিত) তোমার সময় এবং মন্দিরের ভেতর জায়গা কেন হবে না শুনি ঠাকরুন?
ষোড়শী। (বিনীত-কণ্ঠে) আপনি ত জানেন রায়মশাই, এখন চড়কের উৎসব। যাত্রীর ভিড়, সন্ন্যাসীর ভিড়, আমারই বা সময় কোথায়, তাদেরই বা সরাই কোথায়?
জনার্দন। (আত্মবিস্মৃত হইয়া সগর্জনে) হতেই হবে! আমি বলচি হতে হবে!
ষোড়শী। (জীবানন্দকে) ঝগড়া করতে আমার ঘৃণা বোধ হয়। তবে ও-সব করবার এখন সুযোগ হবে না, এই কথাটা আপনার অনুচরদের বুঝিয়ে বলে দেবেন। আমার সময় অল্প; আপনাদের কাজ মিটে থাকে ত আমি চললাম।
জীবানন্দ। (তপ্তস্বরে) কিন্তু আমি হুকুম দিয়ে যাচ্ছি, আজই এ-সব হতে হবে এবং হওয়াই চাই।
ষোড়শী। জোর করে?
জীবানন্দ। হাঁ, জোর করে।
ষোড়শী। সুবিধে-অসুবিধে যাই-ই হোক?
জীবানন্দ। হাঁ, সুবিধে-অসুবিধে যাই-ই হোক।
ষোড়শী। (পিছনে চাহিয়া ভিড়ের মধ্যে সাগরকে অঙ্গুলি-সঙ্কেতে আহ্বান করিয়া) সাগর, তোদের সমস্ত ঠিক আছে?
সাগর। (সবিনয়ে) আছে মা, তোমার আশীর্বাদে অভাব কিছুই নেই।
ষোড়শী। বেশ। জমিদারের লোক আজ একটা হাঙ্গামা বাধাতে চায়, কিন্তু আমি তা চাইনে। এই গাজনের সময়টায় রক্তপাত হয় আমার ইচ্ছে নয়, কিন্তু দরকার হলে করতেই হবে। এই লোকগুলোকে তোরা দেখে রাখ্, এঁদের কেউ যেন আমার মন্দিরের ত্রিসীমানায় না আসতে পারে। হঠাৎ মারিস্ নে—শুধু বার করে দিবি।
[প্রস্থান
ষোড়শী – ২.১
দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
ষোড়শীর কুটীর
[সন্ধ্যা এইমাত্র উত্তীর্ণ হইয়াছে। গৃহের অভ্যন্তরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। বাহিরে ষোড়শী উপবিষ্ট। এমনি সময়ে নির্মল ও হৈম প্রবেশ করিল। পিছনে ভৃত্য]
ষোড়শী। এস, এস, কিন্তু এ কি কাণ্ড! তোমাদের যে আজ দুপুরের গাড়িতে যাবার কথা ছিল?
[নির্মল ও হৈম নিকটে উপবেশন করিল]
হৈম। কথা ছিল, কিন্তু যাইনি। এঁকেও যেতে দিইনি। দিদির এই নতুন ঘরখানি চোখে দেখে না গেলে দুঃখ করতে হতো।
নির্মল। চোখে দেখে গিয়েও দুঃখ কম করতে হবে মনে হয় না।
হৈম। সে ঠিক। হয়ত চোখে না দেখলেই ছিল ভালো। এ ঘরের আর যা দোষ থাক, অপব্যয়ের অপবাদ শিরোমণিমশায় কেন, বোধ হয় আমার বাবাও দিতে পারেন না। কিন্তু এ পাগলামি কেন করতে গেলে দিদি, এ ঘরে ত তুমি থাকতে পারবে না!