প্রফুল্ল। (ব্যাকুল হইয়া) কি বলচেন দাদা? থাক, থাক, আর একসময়ে হবে। (ফিরিতে উদ্যত হইল)
জীবানন্দ। (সহাস্যে) আরে লজ্জা কি ভায়া, এঁরা সব আপনার লোক, জ্ঞাতগোষ্ঠী, এমন কি মণিমাণিক্যের এপিঠ-ওপিঠ বললেও অত্যুক্তি হয় না! তা ছাড়া তোমার দাদাটি যে কস্তুরী-মৃগ; সুগন্ধ আর কতকাল চেপে রাখবে ভাই? প্রফুল্ল, রাগ করো না ভায়া, আপনার বলতে আর কাউকে বড় বাকী রাখিনি, কিন্তু এই চল্লিশটা বছরের অভ্যাস ছাড়তে পারব বলেও ভরসা নেই, তার চেয়ে বরঞ্চ নোট-টোট জাল করতে পারে এমন যদি কাউকে যোগাড় করে আনতে পারতে হে—
প্রফুল্ল। (অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াও হাসিয়া ফেলিয়া) দেখুন, সবাই আপনার কথা বুঝবে না। সত্য ভেবে যদি কেউ—
জীবানন্দ। (গম্ভীর হইয়া) সন্ধান করে নিয়ে আসেন? তা হলে ত বেঁচে যাই প্রফুল্ল। রায়মশায়, আপনি ত শুনি অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনার জানাশুনা কি এমন কেউ—
জনার্দন। (ম্লানমুখে উঠিয়া) বেলা হলো যদি অনুমতি করেন ত—
জীবানন্দ। বসুন, বসুন, নইলে প্রফুল্লর জাঁক বেড়ে যাবে। তা ছাড়া ভৈরবীর কথাটা শেষ হয়ে যাক। কিন্তু আমি যাও বললেই কি সে যাবে?
জনার্দন। সে ভার আমাদের।
জীবানন্দ। কিন্তু আর কাউকে ত বাহাল করা চাই। ও ত খালি থাকতে পারে না।
অনেকে। সে ভারও আমাদের।
জীবানন্দ। যাক বাঁচা গেল, তবে সে যাবেই। এতগুলো মানুষের বিশ্বাসের ভার একা ভৈরবী কেন, স্বয়ং মা-চণ্ডীও সামলাতে পারেন না। আপনাদের লাভ-লোকসান আপনারাই জানেন, কিন্তু আমার এমন অবস্থা যে, টাকা পেলে আমার কিছুতেই আপত্তি নেই। নতুন বন্দোবস্তে আমার কিছু পাওয়া চাই। ভালো কথা, কেউ দেখ্ ত রে এককড়ি আছে না গেছে? কিন্তু গলাটা এদিকে যে মরুভূমি হয়ে গেল।
বেয়ারা। (প্রবেশ করিয়া প্রভুর ব্যগ্র-ব্যাকুল হস্তে পূর্ণপাত্র দিয়া) তিনি রান্নাবাড়ার ঘরগুলো দেখচেন।
জীবানন্দ। এর মধ্যেই? ডাক্ তাকে। (মদ্যপান)
[ইহার পর হইতে পূজার্থীরা মন্দিরে প্রবেশ করিতে লাগিল ও পূজা শেষ করিয়া বাহির হইয়া যাইতে লাগিল—তাদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়িতে লাগিল। এককড়ি প্রবেশ করিল]
জীবানন্দ। আজ যে ভৈরবীকে তলব করেছিলাম, কেউ তাঁকে খবর দিয়েছিল?
এককড়ি। আমি নিজে গিয়েছিলাম।
জীবানন্দ। তিনি এসেছিলেন?
এককড়ি। আজ্ঞে না।
জীবানন্দ। না কেন? (এককড়ি অধোমুখে নীরব) তিনি কখন আসবেন, জানিয়েছেন?
এককড়ি। (তেমনি অধোমুখে) এত লোকের সামনে আমি সে কথা হুজুরে পেশ করতে পারব না।
জীবানন্দ। এককড়ি তোমার গোমস্তাগিরি কায়দাটা একটু ছাড়। তিনি আসবেন না,—না?
এককড়ি। না।
জীবানন্দ। কেন?
এককড়ি। তিনি আসতে পারবেন না। তিনি বললেন, তোমার হুজুরকে বলো এককড়ি, তাঁর বিচার করবার মত বিদ্যে-বুদ্ধি থাকে ত নিজের প্রজাদের করুন গে—আমার বিচার করবার জন্যে আদালত খোলা আছে।
জীবানন্দ। (অন্ধকার-মুখে) হুঁ। আচ্ছা তুমি যাও।
[এককড়ির প্রস্থান
জীবানন্দ। প্রফুল্ল, সেই যে চিনির কোম্পানির সঙ্গে হাজার বিঘে জমি বিক্রির কথা হয়েছিল, তার দলিল লেখা হয়েছে?
প্রফুল্ল। আজ্ঞে হয়েছে।
জীবানন্দ। এক্ষুণি তুমি গিয়ে সেটা পাকাপাকি কর গে। লিখে দাও জমি তারা পাবে।
প্রফুল্ল। তাই হবে।
[পূজার্থী ও পূজার্থিনীরা যাইতেছে আসিতেছে]
জীবানন্দ। আজ যে পূজার বড় ভিড় দেখছি। না, রোজই এইরকম?
জনার্দন। আজকের একটু বিশেষ আয়োজন ত আছেই, তা ছাড়া এই চড়কের সময়টায় কিছুদিন ধরে এমনিই হয়। লোকজনের ভিড় এখন বাড়তেই থাকবে।
জীবানন্দ। তাই নাকি? বেলা হলো এখন তা হলে আসি। (হাসিয়া) একটা মজা দেখেছেন রায়মশায়, চণ্ডীগড়ের লোকগুলো প্রায়ই ভুলে যায় যে, জমিদার এখন কালীমোহন নয়—জীবানন্দ চৌধুরী। অনেক প্রভেদ, না?
[জনার্দন কি যে জবাব দিবে ভাবিয়া পাইল না। শুধু তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল]
জীবানন্দ। এখানে বীজগাঁ’র প্রজা নয় এমন একটা প্রাণীও নেই। ঠিক না শিরোমণিমশায়?
শিরোমণি। তাতে আর সন্দেহ কি হুজুর!
জীবানন্দ। না, আমার সন্দেহ নেই, তবে আর কারও না সন্দেহ থাকে। আচ্ছা, নমস্কার শিরোমণিমশায়, চললাম। (হাসিয়া) কিন্তু ভৈরবী-বিদায়ের পালাটা শেষ করা চাই। প্রফুল্ল, যাওয়া যাক।
[প্রস্থান
শিরোমণি। (জমিদার সত্যই গেল কিনা উঁকি মারিয়া দেখিয়া) জনার্দন, কিরূপ মনে হয় ভায়া?
জনার্দন। মনে ত অনেক কিছুই হয়।
শিরোমণি। মহাপাপিষ্ঠ—লজ্জা-শরম আদৌ নেই।
জনার্দন। (গম্ভীরমুখে) না।
শিরোমণি। ভারী দুর্মুখ। মানীর মান-মর্যাদার জ্ঞান নেই।
জনার্দন। না।
শিরোমণি। কিন্তু দেখলে ভায়া কথার ভঙ্গী? সোজা না বাঁকা, সত্য না মিথ্যা, তামাশা না তিরস্কার, ভেবে পাওয়াই দায়। অর্ধেক কথা ত বোঝাই গেল না, যেন হেঁয়ালি। পাষণ্ড সত্যি বললে, না আমাদের বাঁদর নাচালে ঠিক ঠাহর করা গেল না। জানে সব, কি বল?
[জনার্দন নিরুত্তর]
শিরোমণি। যা ভাবা গিয়েছিল ব্যাটা হাবা-গোবা নয়—বিশেষ সুবিধে হবে না বলেই যেন শঙ্কা হচ্চে, না?
জনার্দন। মায়ের অভিরুচি।
শিরোমণি। তার আর কথা কি! কিন্তু ব্যাপারটা যেন খিচুড়ি পাকিয়ে গেল। না গেল একে ধরা, না গেল তাকে মারা। তোমার কি ভায়া, পয়সার জোর আছে, ছুঁড়ী যক্ষের মত আগলে আছে, গেলে সুমুখের বাগান-বেড়াটা তোমার টানা দিয়ে চৌকোস হতে পারবে।কিন্তু বাঘের গর্তের মুখে ফাঁদ পাততে গিয়ে না শেষে আমি মারা পড়ি।