জীবানন্দ। না, না, উনি অনেক পরিশ্রম করেছেন, বুড়ো মানুষকে আর কষ্ট দিয়ে কাজ নেই, ব্যাপারটা আপনিই ব্যক্ত করুন।
জনার্দন। (চোখে ও মুখে দ্বিধা ও সঙ্কোচের ভাব আনিয়া) ব্রাহ্মণ-কন্যা—এ আদেশ আমাকে করবেন না।
জীবানন্দ। গো-ব্রাহ্মণে আপনার অচলা ভক্তির কথা এদিকে কারও অবিদিত নেই। কিন্তু এতগুলি ইতর-ভদ্রকে নিয়ে আপনি নিজে যখন উঠেপড়ে লেগেছেন, তখন ব্যাপার যে অতিশয় গুরুতর তা আমার বিশ্বাস হয়েছে। কিন্তু সেটা আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।
জনার্দন। (শিরোমণির প্রতি ক্রুদ্ধদৃষ্টি হানিয়া) হুজুর যখন নিজে শুনতে চাচ্ছেন তখন আর ভয় কি ঠাকুর? নির্ভয়ে জানিয়ে দিন না।
শিরোমণি। (ব্যস্ত হইয়া) সত্যি কথায় ভয় কিসের জনার্দন? তারাদাসের মেয়েকে আর আমরা কেউ রাখব না হুজুর! তার স্বভাব-চরিত্র ভারী মন্দ হয়ে গেছে—এই আপনাকে আমরা জানিয়ে দিচ্ছি।
[জীবানন্দের পরিহাস-দীপ্ত প্রফুল্ল মুখ অকস্মাৎ গম্ভীর ও কঠিন হইয়া উঠিল]
জীবানন্দ। তাঁর স্বভাব-চরিত্র মন্দ হবার খবর আপনারা নিশ্চয় জেনেছেন?
[সকলে ঘাড় নাড়িল]
জীবানন্দ। তাই সুবিচারের আশায় বেছে বেছে একেবারে ভীষ্মদেবের শরণাপন্ন হয়েছেন রায়মশায়?
শিরোমণি। আপনি দেশের রাজা—সুবিচার বলুন, অবিচার বলুন, আপনাকেই করতে হবে। আমাদেরও তাই মাথা পেতে নিতে হবে। সমস্ত চণ্ডীগড় ত আপনারই।
জীবানন্দ। (মৃদু হাসিয়া) দেখুন শিরোমণিমশায়, অতি-বিনয়ে আপনাদেরও খুব হেঁট হয়ে কাজ নেই, অতি-গৌরবে আমাকেও আকাশে তোলবার প্রয়োজন নেই। আমি শুধু জানতে চাই, এ অভিযোগ কি সত্য?
[অনেকেই উত্তেজনায় চঞ্চল হইয়া উঠিল]
শিরোমণি। অভিযোগ? সত্য কিনা!—আচ্ছা, আমরা না হয় পর, কিন্তু তারাদাস, তুমিই বল ত। রাজদ্বার, যথাধর্ম বলো—
[তারাদাস একবার পাংশু একবার রাঙ্গা হইয়া উঠিতে লাগিল। জনার্দনের ক্রুদ্ধ একাগ্র দৃষ্টি খোঁচা মারিয়া যেন তাহাকে বারংবার তাড়না করিতে লাগিল। সে একবার ঢোঁক গিলিয়া একবার কণ্ঠের জড়িমা সাফ করিয়া অবশেষে মরিয়ার মত বলিয়া উঠিল]
তারাদাস। হুজুর—
জীবানন্দ। (হাত তুলিয়া তাহাকে থামাইয়া দিয়া) ওর মুখ থেকে ওর নিজের মেয়ের কলঙ্কের কথা আমি যথাধর্ম বললেও শুনব না। বরঞ্চ আপনাদের কেউ পারেন ত যথাধর্ম বলুন।
[ভৃত্য অন্তরালে ছিল, সে টম্ব্লার ভরিয়া হুইস্কি সোডা প্রভুর হাতে আনিয়া দিল। তিনি এক নিশ্বাসে পান করিয়া বেয়ারার হাতে ফিরাইয়া দিলেন]
জীবানন্দ। আঃ—বাঁচলাম। আপনাদের অজস্র বাক্য-সুধা পান করে তেষ্টায় বুক পর্যন্ত কাঠ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চুপচাপ যে! কি হলো আপনাদের যথাধর্মের?
[শিরোমণি নাকে কাপড় দিয়াছিলেন]
জীবানন্দ। (সহাস্যে) শিরোমণিমশায় কি ঘ্রাণে অর্ধভোজনের কাজটা সেরে নিলেন নাকি?
[অনেকেই হাসিয়া মুখ ফিরাইল]
শিরোমণি। (হতবুদ্ধি হইয়া) এই যে বলি হুজুর। আমি যথাধর্মই বলব।
জীবানন্দ। (ঘাড় নাড়িয়া) সম্ভব বটে। আপনি শাস্ত্রজ্ঞ প্রবীণ ব্রাহ্মণ, কিন্তু একজন স্ত্রীলোকের নষ্ট-চরিত্রের কাহিনী তার অসাক্ষাতে বলার মধ্যে আপনার যথাটা যদিই বা থাকে, ধর্মটা থাকবে কি? আমার নিজের কোন বিশেষ আপত্তি নেই—ধর্মাধর্মের বালাই আমার বহুদিন ঘুচে গেছে—তবু আমি বলি, ওতে কাজ নেই। বরঞ্চ আমি যা জিজ্ঞাসা করি তার জবাব দিন। বর্তমান ভৈরবীকে আপনারা তাড়াতে চান—এই না?
সকলে। (মাথা নাড়িয়া) হাঁ, হাঁ।
জীবানন্দ। এঁকে নিয়ে আর সুবিধা হচ্ছে না?
জনার্দন। (প্রতিবাদের ভঙ্গীতে মাথা তুলিয়া) সুবিধে-অসুবিধে কি হুজুর, গ্রামের ভালর জন্যেই প্রয়োজন।
জীবানন্দ। (হাসিয়া ফেলিয়া) অর্থাৎ গ্রামের ভালমন্দের আলোচনা না তুলেও এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, আপনার ভালমন্দ কিছু একটা আছেই। তাড়াবার আমার ক্ষমতা আছে কিনা জানিনে, কিন্তু আপত্তি বিশেষ নেই। কিন্তু আর কোন একটা অজুহাত তৈরি করা যায় না? দেখুন না চেষ্টা করে। বরঞ্চ আমাদের এককড়িটিকেও না হয় সঙ্গে নিন, এ বিষয়ে তার বেশ একটু হাতযশ আছে।
[সকলে অবাক হইয়া রহিল]
জীবানন্দ। এঁদের সতীপনার কাহিনী অত্যন্ত প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ; সুতরাং তাকে আর নাড়াচাড়া করে কাজ নেই। ভৈরবী থাকলেই ভৈরব এসে জোটে এবং ভৈরবদেরও ভৈরবী নইলে চলে না, এ অতি সনাতন প্রথা—সহজে টলানো যাবে না। দেশসুদ্ধ ভক্তের দল চটে যাবে, হয়ত বা দেবী নিজেও খুশী হবেন না—একটা হাঙ্গামা বাধবে।মাতঙ্গী ভৈরবীর গোটা-পাঁচেক ভৈরব ছিল, এবং তাঁর পূর্বে যিনি ছিলেন তাঁর নাকি হাতে গোনা যেত না। কি বলেন, শিরোমণিমশাই, আপনি ত এ অঞ্চলের প্রাচীন ব্যক্তি, জানেন ত সব?
শিরোমণি। (শুষ্কমুখে জনান্তিকে) কি জানি, শুনেছি নাকি?
[প্রফুল্ল প্রবেশ করিল, তার হাতে ইংরিজি-বাংলা কয়েকখানা সংবাদপত্র ও কতকগুলো খোলা চিঠিপত্র]
জীবানন্দ। কিহে প্রফুল্ল, এখানেও ডাকঘর আছে নাকি? আঃ—কবে এইগুলো সব উঠে যাবে?
প্রফুল্ল। (ঘাড় নাড়িয়া) সে ঠিক। গেলে আপনার সুবিধে হতো। কিন্তু সে যখন হয়নি তখন এগুলো দেখবার কি এখন সময় হবে? অত্যন্ত জরুরি।
জীবানন্দ। তা বুঝেছি, নইলে এখানে আনবে কেন? কিন্তু দেখবার সময় আমার এখনও হবে না, অন্য সময়েও হবে না। কিন্তু ব্যাপারটা বাইরে থেকেই উপলব্ধি হচ্ছে। ওই যে হীরালাল-মোহনলালের দোকানের ছাপ। পত্রখানি তাঁর উকিলের, না একেবারে আদালতের হে? ও খামখানা ত দেখচি সলোমন সাহেবের। বাবা, বিলিতি সুধার গন্ধ যেন কাগজ ফুঁড়ে বার হচ্চে। কি বলেন সাহেব? ডিক্রি জারি করবেন, না এই রাজবপুখানি নিয়ে টানা-হেঁচড়া করবেন—জানাচ্চেন? আঃ—সেকালের ব্রাহ্মণ্যতেজ যদি কিছু বাকী থাকত ত এই ইহুদি ব্যাটাকে একেবারে ভস্ম করে দিতাম। মদের দেনা আর শুধতে হতো না।