না। আচ্ছা চাটুয্যে সাহেব—
বলুন।
আচ্ছা, আলী সাহেবের বেগমদের কার কত বয়েস জানেন—মানে অনুমান আপনার—আপনি তো সকলেরই জবানবন্দি নিয়েছেন–
হ্যাঁ–রৌশনারার বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্নর কম হবে না—
দ্বিতীয়া—হিন্দু নারী মাণিক বেগমেরতার বয়সও চল্লিশের ঊর্ধ্বে তো হবেই–
দেখতে কেমন? Dont mind-বেগম সাহেবানরা?
রৌশনারা এককালে সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায় তবে দেহে এখন বার্ধক্যের ছাপ পড়ায়—
বুঝেছি—আর মানিক বেগম সাহেবা?
রূপের দিক থেকে তিনি যে খুব একটা—তা কিছু নয় কালো বোগা চেহারা, তবে চোখে মুখে প্রখর একটা বুদ্ধির দীপ্তি আছে দেখলেই বোঝা যায়।
আপনি তো বলছিলেন নবাব সাহেব ও তাঁর বেগম সাহেবরা ছাড়াও এখানে আলীর কে একজন আত্মীয় আছেন
হ্যাঁ–নাসির হোসেন সাহেব–
কে সে?
একটু আগে যে বললাম, নবাব সাহেবের ভাগ্নে—
হ্যাঁ, মনে পড়েছে।
একটু থেমে আবার কিরীটী প্রশ্ন করে, দাসদাসী এখানে কজন আছে?
পাঁচজন দাসী ও চারজন ভৃত্য—
মোতি তো জাহানারার খাস দাসী ছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
বয়স কত, দেখতে কেমন?
বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে–দেখতে তেমন ভালো নয়–তবে মনে হয় খুব চালাক-চতুর আর–
বলুন, থামলেন কেন?
আর একটা দাসী আছে এ বাড়িতে–নাম কুলসম—
কুলসম?
হ্যাঁ।
কার দাসী?
মানিক বেগমের খাস দাসী। অল্প বয়স–কুড়ি-পঁচিশের বেশী হবে না—দেখতে বেশ। কুলসম।
সুন্দর বলুন।
তা বলতে পারেন।
হুঁ–দেখেই মনে হয়েছিল—
কাকে–কাকে দেখে মনে হয়েছিল?
সেকথার জবাব না দিয়ে কিরীটীবলে, চলুন—এ ঘরের্যাদেখবার দেখা হয়ে গিয়েছে—অন্য একটা ঘরে গিয়ে বসা যাক–
বেশ, আলী সাহেবের বসবার ঘরে গিয়ে বসা যাক চলুন—
চলুন—ঐ ঘরে বসেই এ বাড়ির মানুষগুলোকে কিছু কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই।
আলি সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন না?
০৬. প্রয়োজন বুঝলে সবার সঙ্গেই দেখা করব
প্রয়োজন বুঝলে সবার সঙ্গেই দেখা করব—শুধু আলী কেন?
সকলে এসে দোতলাতেই আলী সাহেবের সোবার ঘরের পাশে বসবার ঘরে ঢুকল।
এ ঘরটি কিন্তু আধুনিক আসবাবপত্রে সজ্জিত। রুচি ও পরিচ্ছন্নতার প্রকাশ সর্বত্র যেন।
মানিকবাবু—
কিরীটীর ডাকে নানিক চাটুয্যে ওর মুখের দিকে তাকাল।
কিছু বলছেন?
হ্যাঁ।
কি বলুন?
একবার আপনাদের দাসী কুলসমকে ডাকবেন?
কুলসম?
হ্যাঁ।
মানিক চাটুয্যে বাইরে গিয়ে ঘরের একজনকে ডেকে কুলসমকে ঐ ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলে দিয়ে এল।
একটা বড় সোফায় কিরীটী বসে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল।
এ বাড়ি—এর ঐতিহ্য ও সব কিছুর সঙ্গে যেন এ ঘরের কিছুরই খাপ খায় না—যেন স্বতন্ত্র রীতিমত একটা পার্থক্য আছে।
মিঃ রায়—
বলুন।
আমার কিন্তু মনে হয়—এ হত্যার ব্যাপারটা বাইরের কারোর দ্বারা সংঘটিত হয়নি।
আপনি বলতে চান বাড়ির মধ্যে কেউ—
হ্যাঁ—আপনার কি মনে হয়?
সম্ভবত তাই। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী কথাটা বলে।
নচেৎ কাল সারাটা রাত ধরে যে ঝড় চলেছে—ঐ দুর্যোগের মধ্যেও কারও—মানে কোন বাইরের কারও এখানে এসে–
কিরীটী কথাটা শেষ করে, হত্যা করে যাওয়াটা তো অসুবিধা নয় বরং আরো সুবিধাই ছিল। মনে করুন—ঐ দুর্যোগের মধ্যে কেউ এসে হত্যা করে গেলে তার আসা-যাওয়ার সময় চট করে কারো নজরে পড়ত না।
কিন্তু–
তাছাড়া বাইরে থেকে জলসাঘরের যে জানলাটা খোলা আছে দেখে এলাম—সেই জানলা পথে ভেতরে প্রবেশ করাটাও খুব সহজ। বাইরে ঐ সময় পদশব্দ শোনা গেল। বৃদ্ধ ভৃত্য দেলোয়ারের সঙ্গে কুলসম এসেছে। মানিক চাটুয্যে ঘরের বাইরে গিয়ে কুলসমকে ভিতরে নিয়ে এল সঙ্গে করে। কিরীটী তাকাল। বোরখা নেই মুখে।
মেয়েটি সুন্দরী সন্দেহ নেই কিন্তু আরশিতে দেখা চকিত সেই মুখখানি নয়। চোখের তারা দুটোতে বুদ্ধির দীপ্তি।
তোমার নাম কুলসম? কিরীটী প্রশ্ন করে।
জী হাঁ।
মাণিক বেগমের দাসী তুমি?
জী হাঁ।
জাহানারা বেগমের ফাইফরমাস কখনও তুমি খাটতে না?
জী না তো! কেন?
ছোট বেগম সাহেবারও দাসী আছে একজন—
কে সে? কি নাম তার?
কেন মোতি!
হুঁ—আচ্ছা কুলসম, এ বাড়িতে তুমি কতদিন কাজ করছ?
কমসে কম দশ সাল তো হবেই।
তবে তো অনেক দিন!
জী হাঁ—
তোমার মনিবান মানে মাণিক বেগম সাহেবাকে ছাড়া এ বাড়িতে সব চাইতে বেশী কাকে তোমার ভালো লাগত?
সে যদি বলেন তোজাহানারা বেগম সাহেবাকেই কথাটা বলতে বলতে গলার স্বরটা যেন কুলসমের রুদ্ধ হয়ে আসে। খুব ভালো ছিলেন বুঝি বেগম সাহেবা?
জী—অমন দিলদরিয়া মানুষ বড় একটা চোখে পড়ে না—তাকে যে কোন্ দুশমন এমন করে খুন করল!
এ বাড়ির সবাই তাকে ভালোবাসত, তাই না?
জী, তাকে ভাল না বেসে কেউ থাকতে পারত না। যেমন দিলদরিয়া তেমনি হাসিখুশি ছিল মানুষটা। কাউকে কখনো একটা চোখ রাঙিয়ে কথাও বলেনি হাসি যেন সর্বক্ষণ বেগম সাহেবার মুখে লেগেই থাকত।
কতদিন হল আলী সাহেব তাঁকে সাদী করেছেন? সেও তো দু সাল হয়ে গেল। বেগম সাহেবার বাপের বাড়িতে কে কে আছেন জান?
এক বুড়ী মা—আর একটা মাতাল গাই—গরীব-ভীষণ গরীবনবাব সাহেবই তো বরাবর তাদের সাহায্য করে আসছেন।
কোথায় তারা থাকে?
শুনেছি মেটিয়াবুরুজ।
আচ্ছা কুলসম?
জী–
এ বাসায় বেশ সুন্দর দেখতে অল্পবয়েসী আর কোন মেয়েছেলে আছে?
জী–মনে হল কুলসম কী বলতে গিয়েও নিজেকে যেন সামলে নিল এবং সঙ্গে সঙ্গে বললে, না—আর কে থাকবেনবাব সাহেবের তিন বেগম সাহেবা আর আমরা দাস-দাসী-আর–
আর—আর কে আছে?
কুণ্ডু বাবু–সিরিটারী বাবু—
তাহলে আর কেউ নেই?