জাহানারা বেগম ও নবাব আসগর আলী সাহেব।
আলী সাহেবের শরীরটা নাকি গত রাত্রে তেমন ভাল ছিল না—তাই রাত দশটার পর তিনি উঠে চলে যান জলসাঘর থেকে।
তারপর একাই নাকি জাহানারা বেগম বসে বসে জলসাঘরে গান গাইছিল।
জাহানারার নিজস্ব দাসী মোতি—জলসাঘরের দরজার বাইরে বসেছিল—অন্যান্য রাত্রে রাত বারোটার বেশী থাকত না জাহানারা জলসাঘরে।
কিন্তু গত রাত্রে সাড়ে বারোটা বেজে গেল তখনো সংগীতের বিরাম নেই তা ছাড়া বাইরে ঝড়জল বসে থাকতে থাকতে দাসী মোতি একসময় নাকি ঘুমিয়ে পড়ে। এবং কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছিল বলতে পারে না।
হঠাৎ এক সময় ঘুম ভেঙে যায়।
সংগীত তখন আর শোনা যাচ্ছে না কেবল ঝড়জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর ঝাউগাছগুলোর সোঁ সোঁ করুণ কান্না।
তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে মোতি।
জলসাঘরের দরজা খোলা-পুঁতির ভারী পদাটা হাওয়ায় দুলছে আর মৃদু ঝিম্ ঝিম্ শব্দ তুলছে।
বেগম সাহেবা কি চলে গেলেন নাকি? কিন্তু তাকে ডাকেন নি কেন? জলসাঘরে আলো জ্বলছে না তো—তবে কি সত্যি চলে গিয়েছেন শয়নঘরে বেগম সাহেবা?
পুঁতির পর্দা সরিয়ে মোতি ঘরের মধ্যে পা দেয়।
ঘরটা অন্ধকার।
একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা—সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে।
কেমন যেন আতঙ্কে সর্বাঙ্গ সিরসির করে ওঠে মোতির।
কয়েকটা মুহূর্ত বিহ্বল হয়ে পড়েছিল।
তারপর সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই তার ঐ বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়ে-সঙ্গে সঙ্গে মোতি চিৎকার করে উঁচচিয়ে ওঠে।
ঘর থেকে পাগলের মত ছুটে বের হয়ে যায়।
০৫. মোতির চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে উঠে
খুন—খুন!
মোতির চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে উঠে এল। মধ্যরাত্রে বাড়িটার মধ্যে যেন একটা চকিত সাড়া পড়ে যায়। আলী সাহেব—অন্যান্য দুই বেগম ঘুম ভেঙ্গে উঠে আসে। নাসির হোসেন ঐ সময় ফিরে আসে বাড়িতে।
কেন-সে কি বাড়িতে ছিল না? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না। মানিক চাটুয্যে বলে।
কোথায় ছিল তবে?
বেলগাছিয়ায় তার এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল বিকেলেই চলে গিয়েছিল।
তারপর?
সবাই বিহ্বল–সবাই বিমূঢ়–অতঃপর কি কর্তব্য—ঐ সময় নীচ থেকে সৌমেন কুণ্ডুকে আলী সাহেব ডেকে পাঠান।
সৌমেন ঘুমোচ্ছিল, উঠে এসে সব শুনে সে তো বোবা।
অবশেষে সৌমেন কুণ্ডুই থানায় খবর দেয়। থানার ও.সি. সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সংবাদ দেয়—দিয়েই সে চলে আসে।
এ তল্লাটের ও.সি. কে?
সুশীলবাবু—সুশীল মুখার্জী–
তাঁকে দেখছি না যে?
আছে সে।
কোথায়?
আলী সাহেবের ঘরে বসে বোধ হয় জবানবন্দি নিচ্ছে।
কিরীটী আর কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে মৃতদেহের সামনে এগিয়ে যায়।
শব স্পর্শ করে। ঠাণ্ডা—হিম। অন্তত কয়েক ঘন্টা আগে যে মৃত্যু হয়েছে সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই।
চেয়ে থাকে মৃতদেহের দিকে কিরীটী। সহসা ডান হাতের অনামিকার প্রতি নজর পড়ে—আঙুলে সুস্পষ্ট অঙ্গুরীর দাগ—অথচ আঙ্গুলে কোন অঙ্গুরী নেই
কিরীটী অতঃপর মৃতদেহের কাছ থেকে সরে এসে ঘরটার চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভাল করে দেখতে লাগল।
খোলা জানলাপথে ঠাণ্ডা জলে হাওয়া আসছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্নই ছিল—আবার বোধ হয় বৃষ্টি নামল। এ বৃষ্টি সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। কিরীটী খোলা জানলাটার সামনে এসে দাঁড়াল।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই দেখেছে জানলাটা খোলা ছিল—জানলাটা দিয়ে সারাটা রাত ধরে বেশ বৃষ্টির ছাট এসেছে বোঝা যায়। মেঝের গালিচার অনেকটা পর্যন্ত সেই ছাটে ভিজে গিয়েছে জানলাপথে বাড়ির পশ্চাৎ দিকটা দেখা যায়—ঐটাই দক্ষিণ দিক।
অনেকখানি খোলা জায়গা বাগান—গাছপালা নানা জাতের জানলাটার একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে হাত দুই মাত্র ব্যবধানে একটা স্বর্ণচাঁপা ফুলের গাছ।
বিরাট উঁচু লম্বা গাছটা। হাওয়ায় ডালপালা ও পাতাগুলো যেন ওলট-পালট করছে। জানলার হাততিনেক নীচে চওড়াকার্নিশ। বরাবর আছে কার্নিশটা—অনায়াসেই ঐকার্নিশপথে এই জানলার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে জানলাটা ধরে এই ঘরে উঠে আসা যেতে পারে।
মানিকবাবু—
কিছু বলবেন? মানিক চাটুয্যে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
এই জানলাটা কি খোলাই ছিল?
তা তো বলতে পারি না।
জাহানারার দাসী মোতিকে জিজ্ঞাসা করেননি কথাটা?
না তো–
হুঁ–খুব সম্ভবতঃ জানলাটা খোলাই ছিল—ঐ দরজাটা তো খোলাই ছিল, তাই না?
হ্যাঁ—ভেজানো ছিল। ও.সি.কে সংবাদ দেন থানায় সৌমেন কুণ্ডুই—
হুঁ। কিরীটী যেন কেমন অন্যমনস্ক হস্তধৃত জ্বলন্ত চুরুটটা ঠোঁটে চেপে ধরে ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
ঘরের মধ্যে গোটা চারেক জানলাসবই বাইরের মানে দক্ষিণমুখী বাগানের দিকে—তিনটি জানলা বন্ধ, একটি মাত্র খোলা। দরজা তিনটে মনে হচ্ছে ওরা একটা দরজা-পথে ঐ ঘরে ঢুকেছে—অন্য দুটো বন্ধ—এবং দরজার গায়ে ভারী পুঁতির পর্দা ঝুলছে। নানা রঙয়ের নানা আকারের পুঁতি।
ঐ দরজাটা বন্ধ দেখছি? কিরীটী মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করে একটা দরজার দিকে তাকিয়ে—
হ্যাঁ-ওটা নাকি বন্ধই থাকে।
ব্যবহার করা হয় না বুঝি?
না—ওটা পাশের ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
পাশের ঘরটায় কে থাকে?
কেউ থাকে না—ও ঘরটার মধ্যে পুরাতন জিনিসপত্র থাকে এখন—আগে অবিশ্যি নবাব সাহেবের বৃদ্ধা ফুপু থাকতেন।
ফুপু-মানে পিসি?
হ্যাঁ।
আর ঐ দরজাটা?
ওটা বাথরুমে যাবার দরজা।
ঘরের সঙ্গে বাথরুম আছে?
হ্যাঁ।
আশ্চর্য—এতদিনকার পুরাতন আমলের বাড়িতে—
কিরীটী কতকটা স্বগতোক্তির মতই মৃদুকণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করে।
মানিক চাটুয্যে জিজ্ঞাসা করে, কিছু বলবেন?