এই ঘরে—
মানিক চাটুয্যে বলে। চলল….
অন্যান্য ঘরের দরজার মত এ ঘরেও পুঁতির পর্দা ঝুলছিল সেই পুঁতির পর্দা সরিয়ে সেই দরজার কবাট ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।
বোঝা গেল দরজাটা ভেজানো ছিল মাত্র।
প্রথমে মানিক চাটুয্যে ও তার পশ্চাতে কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই দাঁড়িয়ে যায় কিরীটী।
ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হচ্ছিল থেকে থেকে, সেই সঙ্গে মৃদু একটা টুং টুং শব্দ। ঘরের মধ্যে।
কিরীটী তাকিয়ে দেখল ঘরের একটা জানলা খোলা।
বাতাসের ঝাপটায় সেই জানলার কাঁচের পুরাতন পাল্লা দুটো খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তুলছে তাতেই। হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপটা এসে ঘরে ঢুকছে। মাথার উপর শিলিং থেকে ঝুলন্ত বিরাট ঝাড়বাতির বেলোয়ারী কাঁচগুলো হাওয়ায় পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে টুং টুং শব্দ করছে, সঙ্গীতের একটা বিলম্বিত সুর যেন।
ঘরের মধ্যে ঝাপসা আলো। রহস্যময় একটা অস্পষ্টতা যেন।
হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হল সঙ্গে সঙ্গে কক্ষটা উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করে উঠল। কিরীটী তাকিয়ে দেখল ঝড়ের মধ্যে ইলেকট্রিক বাল্বগুলো একসঙ্গে সব জ্বলে উঠেছে।
সুইচটা টিপে মানিক চাটুয্যেই আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রখর আলোয় ঘরটা যেন এতক্ষণে চোখের সামনে দেখা দিল।
কারো শয়ন বা বসবার ঘর নয় এটা। জলসাঘর। মেঝেতে পুরু গালিচা বিছানোবড় বড় তাকিয়া-তাতে রেশমী ঝালর দেওয়া—চারদিকে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র ছড়ানো। সেতার সারেঙ্গী বীণা সরোদ তানপুরা বাঁয়া তবলা ইত্যাদি—আর তারই মাঝখানে একটি নারীদেহ এলিয়ে পড়ে আছে। শুধুমাত্র সুন্দর বললেই বোধ হয় সব বলা হয় না—অতুলনীয় সুন্দর—এবং শুধু সুন্দর নয়, যেন আশ্চর্য!
কিরীটীর মনে হয় এমনটি বুঝি আর সে ইতিপূর্বে দেখেনি।
বয়স কতই বা হবে কুড়ির বেশী হবে না। পরনে দামী রেশমের শালোয়ার ও কাঁচুলী, তার উপর একটি সুক্ষ্ম ওড়না—ডানদিকের বুকে একটা ছোরা আমূল বিদ্ধ।
কাঁচুলীটা রক্তে লাল হয়ে রয়েছে
কানে হীরের কণাভরণ। হাতে দুগাছি করে প্ল্যাটিনামের উপরে হীরের চুড়ি। পায়ে ও হাতের পাতায় মেহেদীর রঙ। মাথায় চুল বেণীবদ্ধতাতে একটি সোনাল ফিতে জড়ানো-এক পাশে বেণীটা সাপের মত এলিয়ে পড়ে আছে।
টানা ভ্রূ। নিমীলিত আঁখিপদ্ম। একটা হাত ছড়ানোঅন্য হাতটা দেহের সঙ্গে লেগে আছে।
ছোরার বাঁটটা সাদা কারুকার্য করা। তরুণীর বক্ষে যদি ছোরাটা আমূল না বিদ্ধ থাকত মনে হত বুঝি সে ঘুমিয়ে আছে।
কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে ভূলুষ্ঠিত প্রাণহীন দেহটার দিকে চেয়ে থাকে।
০৪. মানিক চাটুয্যেই প্রথমে কথা বলে
মানিক চাটুয্যেই প্রথমে কথা বলে।
আলী সাহেবের সর্বকনিষ্ঠা বেগম–জাহানারা।
জাহানারা?
হ্যাঁ। বয়স বেশী বলে তো মনে হচ্ছে না!
না।
হুঁ। ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছেন? কখন ব্যাপারটা ঘটেছে বা কে প্রথম জানতে পারল
মোটামুটি যা জানতে পেরেছি–নাসির হোসেনের কাছে–
নাসির হোসেন?
হ্যাঁ—আলী সাহেবের ভাগ্নে। ওঁর বোনের—সুলতানা বেগমের একমাত্র ছেলে—
নাসির হোসেন সাহেব এখানেই থাকেন তো?
হ্যাঁ।
নাসির হোসেন যা বলেছিল মানিক চাটুয্যেকে, অতঃপর সেই কাহিনী বিবৃত করে মানিক চাটুষ্যে।
আলী সাহেবের তিন বেগম।
রৌশনারা বেগমমাণিক বেগম ও সর্বকনিষ্ঠা জাহানারা বেগম।
বড় বেগম রৌশনারার বয়স বাহান্ন-পঞ্চান্নর উর্ধেই হবে—
মধ্যমা মাণিক বেগম-মুসলমানেরা ঘরের মেয়ে নয়—হিন্দুর কন্যা আগেই বলা হয়েছে।
মুসলিম ধর্ম গ্রহণের পর মণিকার নাম বদলে আলী সাহেব তার নাম রাখেন মাণিক। মাণিক আলী সাহেবের দেওয়া আদরের নাম।
নবাব আলী সাহেবের এক হিন্দু কর্মচারী ছিল যতীন চাটুয্যে—তারই কন্যা ঐ মণিকা।
সর্বকনিষ্ঠা জাহানারাকে আলী সাহেব মাত্র বছর দুই আগে সাদী করেছিলেন।
আসগর আলী সাহেবের বয়স এখন প্রায় বাহাত্তর-তিয়াত্তর হবে। বৃদ্ধ হলেও কিন্তু দেখে সেটা বুঝবার উপায় নেই। দীর্ঘ লম্বা পাতলা চেহারা। টকটকে গৌর গাত্রবর্ণ। এখনো সোজা হয়ে হাঁটা-চলা করেন। মাথার চুল ও দাড়ি পেকে অবশ্য সাদা হয়ে গিয়েছে। খুব আমুদে রাশভারী মানুষ।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, শুধু তাই বলুন শক্তিমান পুরুষও–
মানিক চাটুয্যে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, নচেৎ তৃতীয়বার বেগম সংগ্রহ করেন ঐ বয়সে!
মানিক চাটুয্যেও হাসে।
বলুন তারপর–
জাহানারা গরিবের ঘরের মেয়ে হলেও অত্যন্ত মেধাবী ছিল বলে বি.এ. পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল নিজের চেষ্টায়। এবং সেই সঙ্গে গানবাজনাও। সংগীতে অপূর্ব মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠ ছিল তার।
নিজের চেষ্টাতেই গান শিখেছিলো লেখাপড়ার মতই।
জাহানারার সঙ্গে আসগর আলী সাহেবের বিবাহের ব্যাপারটাও নাকি বিচিত্রজাহানারা নাকি ইচ্ছে করেই আসগর আলী সাহেবকে সাদী করেছে।
অনেকেই ব্যাপারটায় যে বিস্মিত হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই।
আসগর আলী সাহেব চিরদিনই একজন সংগীত-রসগ্রাহী। সংগীতকে তিনি বরাবরই ভালবাসতেন বলে প্রায়ই তাঁর গৃহের জলসাঘরে গানের জলসা বসত। বহু গুণী জ্ঞানী সংগীতশিল্পীরা ঐ জলসাঘরে এসে মাইফেলে যোগ দিয়ে গিয়েছেন। তা ছাড়াও মধ্যে মধ্যে জাহানারা একাই সংগীতের আসর বসাত। এবং সে আসরে শ্রোতা থাকতেন তার স্বামীই—আসগর আলী সাহেব।
গত রাত্রেও তেমনি সংগীতের আসর বসেছিল ঐ জলসাঘরে। দুটি মাত্র প্রাণী।