বৃদ্ধ নবাব আসগর আলী সাহেব।
আসগর আলী!
হ্যাঁ—এরা লক্ষ্ণৌর নবাব বংশেরই একটা শাখা। মানিক চাটুয্যে বলে।
কি রকম?
তিন পুরুষ আগে লক্ষ্ণৌ থেকে এরা চলে এসে প্রথমে মেটেবুরুজে বসবাস করেছিল কিছুদিন; তারপর এসে এই মতিমঞ্জিল তৈরী করে—মানে ঐ আলী সাহেবের ঠাকুদা—অবশ্য তারও তখন প্রৌঢ় বয়স।
অনেক বছর আগে নিশ্চয়ই? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ-লর্ড ক্যানিং-এর আমলে সেটা।
হুঁ–তা ঐ নবাব আলী সাহেবের কে কে আছেন?
আপনার বলতে এক ভাগ্নে—আর তিন বেগম—
কোন ছেলেপিলে কিছু নেই? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
ছেলে এক ছিল।
বেঁচে নেই বুঝি?
আছে তবে বাপের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
সম্পর্ক নেই মানে?
হ্যাঁ—সে বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে বহুদিন পৃথক হয়ে গিয়েছে।
কোথায় থাকে সে? এই শহরেই কি?
হ্যাঁ—এই শহরেই—মেটেবুরুজে।
বয়স কত তার?
তা শুনেছিলাম ত্রিশ-বত্রিশ হবে রোশন আলী নাম—নামটা হয়ত আপনি শুনে থাকবেন বিখ্যাত সেতারিয়া রোশন আলী।
কিরীটী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আরে রোশন আলীকে তো আমি খুব ভালভাবে চিনি, অতি চমৎকার সজ্জন ব্যক্তি যেমন চেহারা তেমনি ব্যবহার।
আমি অবিশ্যি তাকে চিনি না।
পরিচয় কোরো—চমৎকার সেতারিয়া। কিরীটী বললে, রোশন সাহেব যাকে বিয়ে করেছেন সেও তো নামকরা শিল্পী
আলী সাহেবের এক বেগমও তো এককালে নামকরা নৃত্যশিল্পী ছিল।
নৃত্যশিল্পী?
হ্যাঁ। নৃত্যশিল্পী মণিকাদেবীর নাম শোনেননি?
হ্যাঁ শুনেছি, কিন্তু সে তো ছিল ব্রাহ্মণের মেয়ে। কিরীটী বলে।
সেই–
ভাল কথা—মণিকাদেবী হঠাৎ বছর কয়েক আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন না?
নিখোঁজ আর কি বম্বেতে পালিয়ে গিয়ে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে ঐ আলী সাহেবকে বিয়ে করে।
বটে! তা বয়সের তো অনেক তফাৎ হবে দুজনের মধ্যে?
তা তো হবেই—তা সেই বেগমও কি
এখানেই আছে।
আর কে আছে এখানে?
কে আর–তিন বেগম, নবাব সাহেব ও তস্য ভাগ্নে ছাড়া আর কেউ নেই এ বাড়িতে আপনার জন বলতে। আছে চাকরবাকর ড্রাইভার—ভাল কথা, ভুলে গিয়েছিলাম, আরো একজন আছে—দাস-দাসী অবিশ্যি—
আরো একজন?
হ্যাঁ। সৌমেন কুণ্ডু নামে এক ভদ্রলোক—ইয়ং ম্যান বয়স ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যে হবে।
তিনি এখানে কি করেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
বলতে পারেন আলী সাহেবের সে-ই সব দেখাশোনা করে সেক্রেটারী—পরামর্শদাতা সব কিছু।
ইতিমধ্যে ওরা কথা বলতে বলতে দীর্ঘ সিঁড়ি অতিক্রম করে দোতলায় পৌঁছে গিয়েছিল।
নীচের তলার মত উপরের তলাতেও একটি প্রশস্ত টানা বারান্দা। একটা দিকে ঘর পর পর—অন্য দিকে কাঠের ঝিলিমিলি বাতাস ও আলো আসার বলতে গেলে কোন পথই নেই। বোধ করি নবাবী আব্রুর জন্যই ঐ সাবধানতা।
বারান্দায় কিছু কিছু শ্বেতপাথরের মূর্তি এখানে-ওখানে দাঁড় করানো।
০৩. বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থাকায় আলোর অভাবে বারুদাটায় আবছা আলোছায়া যেন কি এক রহস্যে থমথম করছে। বারান্দায় কোন জনপ্রাণীকে দেখা গেল না।
কিরীটী মানিকের সঙ্গে পাশপাশি হেঁটে চলে।
পর পর সব ঘর। ঘরের দরজায় দরজায় সব পুঁতির পদা ঝুলছে।
তৃতীয় দ্বারপথে মানিক চাটুয্যেকে অনুসরণ করে পুঁতির পর্দা সরিয়ে কিরীটী একটা হলঘরের মতই প্রশস্ত ঘরে প্রবেশ করল। ঘরের মেঝেতে কার্পেট বিছানো। পুরনো আমলের ভারী দামী আসবাব। আর বিরাট একটা আরশি—সুদৃশ্য চওড়া সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো—ঘরের পূর্ব ও পশ্চিম দেওয়ালে একেবারে মুখখামুখি টাঙানো।
যে দরজা-পথে ওরা ঘরে প্রবেশ করেছিল সে দরজা ছাড়াও একটি পশ্চিমমুখী দরজা দেখা গেল ঘরে। তাতেও ঐ একই ধরনের পর্দা ঝুলছে। গোটাচারেক জানলা। সবই দক্ষিণমুখী। জানলাগুলো বন্ধই ছিল একটি বাদে।
কিরীটী প্রশ্ন করে, ডে বডি কোথায়?
ঐ পূব দিককার ঘরে, আসুন না।
কিরীটী মানিক চাটুয্যেকে অনুসরণ করে।
কয়েক পা অগ্রসর হয়েই সহসা ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আরশির মসৃণ গাত্রে ওর নজর পড়তেই ও যেন নিজের অজ্ঞাতেই থমকে দাঁড়িয়ে যায় মুহূর্তের জন্য।
একটি নারীর মুখ চকিতে ভেসে উঠেছিল আরশির মসৃণ গাত্রে। বোরখায় আবৃত মুখখানা। কিন্তু মুহূর্তের জন্য বোরখা মুখের উপর থেকে অপসারিত হয়েছিল।
কি সুন্দর কি কমনীয় একখানি নারীর মুখ। টানা জ্ব। টানা টানা দুটি চোখ। আর সেই চোখের তারায় যেন একটা ভীতি একটা সংশয়।
কিরীটী থমকে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই আরশির গা থেকে সে মুখের প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে যায়। কিরীটীকে থামতে দেখে মানিক চাটুয্যে শুধাল, কি হল?
না—কিছু না—চলল।
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সহসা নারীকণ্ঠের একটি হাসির তরঙ্গ যেন সেই স্তব্ধ গৃহের দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়িয়ে পড়ল।
খিলখিল করে কে হাসছে। হাসির শব্দটা যেন হঠাৎ উঠে হঠাৎই আবার মিলিয়ে গেল।
মিলিয়ে গেল নবাব আলী আসগর সাহেবের জীর্ণ অট্টালিকার দেওয়ালে দেওয়ালে, যেন শুষে নিল সেই হাসির শব্দটা।
বাইরে ঝড়-বৃষ্টি তেমনি চলেছে। সোঁ সোঁ হাওয়ায় ঝাউগাছের কান্না তেমনি শোনা যায়।
কিরীটী মানিক চাটুয্যের দিকে তাকায় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে।
মানিক চাটুয্যেও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেই হাসির শব্দে।
কে হাসল যেন মনে হল? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ শুনলাম, মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয় মানিক চাটুয্যে, দেখব খোঁজ নিয়ে?
না থাক, চলো।
কিরীটী কথাটা বলে মানিক চাটুয্যেকে এগিয়ে যাবার ইঙ্গিত করে।
কয়েক পা অগ্রসর হতেই দুজনে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।