ঘরের মধ্যে তখনো ঠিক তেমনিই সব দাঁড়িয়ে।
মানিক চাটুয্যে, সুশীল মুখার্জী, মেহেরউন্নিসা, আর বসে নবাব আসগর আলী সাহেব।
১৬. মেহেরউন্নিসার দিকে তাকিয়ে
মেহেরউন্নিসার দিকে তাকিয়ে কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন শুরু করে।
দেখুন আপনি কি কখনো সিনেমায় নেমেছেন, কোন ছবিতে?
মেহেরউন্নিসা কয়েকটা মুহূর্ত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদুকণ্ঠে বলে, হ্যাঁ।
এখন মনে পড়েছে। কোন একটা কাগজে আপনার ছবি কয়েকদিন আগেই মাত্র দেখেছি। কিরীটী বলে।
চিত্রালীতে—চিত্রালী আমার ছবি ছেপেছে কিছুদিন আগে।
মেহেরউন্নিসা মৃদু কণ্ঠে বলে।
জাহানারার সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক?
সে—
বলুন কি সম্পর্ক? আপনার সঙ্গে যে রক্তের তাঁর সম্পর্ক আছে বুঝতে পেরেছি, অতএব ঢাকবার চেষ্টা করবেন না।
সে আমার দিদি। দিদি!
মায়ের পেটের বোন আপনার?
হ্যাঁ।
কতদূর লেখাপড়া করেছেন আপনি?
আমি গত বৎসর বি.এ. পাস করেছি।
কোন্ কলেজ থেকে?
বহরমপুর থেকে।
সেখানেই বরাবর থাকতেন?
হ্যাঁ, আমাদের কাকার কাছেই সেখানে থাকতাম। কলকাতায় এসে অবধি এখানে।
কলকাতায় কতদিন এসেছেন?
মাস ছয়েক হল।
এখানেই, মানে এই বাড়িতেই নিশ্চয়ই আছেন?
না, মধ্যে মধ্যে আসি। থাকি আমি শ্যামবাজার—আমার এক মাসীর কাছে।
কটা বইতে অভিনয় করেছেন?
খান তিনেক বইতে।
সবটাতেই নায়িকা?
না, শেষটায় নায়িকা।
হুঁ—আচ্ছা বোরখা ব্যবহার করা আপনার অভ্যাস নয়–তাই না?
আমি বোরখা ব্যবহার করি না।
তবে যে বোরখা এখন পরেছিলেন?
মেহেরউন্নিসা চুপ। বোবা।
আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতে চাননি, তাই কি?
মেহেরউন্নিসা নীরব।
মানিকবাবু!
আজ্ঞে?
মোতি দাসীকে ডাকুন তো একবার।
মানিক চাটুয্যে তখুনি বের হয়ে গেল।
মেহেরের দিকে অতঃপর তাকিয়ে কিরীটী বলে, একটা কথার সত্যি জবাব দিন—আপনার এখানে এ ভাবে আসা—আপনার দিদি নিশ্চয়ই পছন্দ করছিলেন না–
মেহেরউন্নিসা পূর্ববৎ নীরব।
অবিশ্যি পছন্দ না করারই কথা—বিশেষ করে যখন তিনি চোখের উপরে নবাব সাহেবের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটা
এসব আপনি কি বলছেন? কিরীটীকে বাধা দিলেন নবাব সাহেব।
কথাটা কি মিথ্যা বলেছি নবাব সাহেব?
চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে জবাব দিল কিরীটী। কণ্ঠস্বর তার তীক্ষ্ণ, আপনার সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠতা একটা নেই বলতে চান—অস্বীকার করতে চান আপনি কথাটা এখন?
অত স্পষ্ট করে কিরীটী মুখের উপর কথাটা বলবে হয়ত ভাবতে পারেননি নবাব সাহেব।
মোতি এসে ঘরে ঢুকল ঐ সময়।
নবাব সাহেব তখন চুপ করে আছেন।
মোতি!
বাবুর্জী?
ঐ বোরখাটা তোমার?
হঠাৎ যেন কেমন থতমত খেয়ে যায় মোতি–ফ্যালফ্যাল করে সকলের মুখের দিকে তাকায়।
কি—চুপ করে আছ কেন, জবাব দাও।
কিরীটী ধমকে ওঠে মোতিকে।
আজ্ঞে—
বল–তোমার কি না?
জী।
তোমার?
জী।
কখন দিয়েছ ওঁকে?
আপনার আসবার পর।
মানে আজই সকালে–কিছুক্ষণ আগে?
জী।
মোতি!
বাবুজী?
তুমি আমার কাছে মিথ্যা কথা বলেছ। ঝুট বলেছ—
মিথ্যা–ঝুট বলেছি?
হ্যাঁ–তুমি বলনি কাল রাত্রে-রাত বারোটার পর নবাব সাহেব হলঘর থেকে বের হয়ে যান?
জী—ঠিকই তো বলেছি।
কিন্তু নবাবু সাহেব বলছেন রাত দশটায় তিনি বের হয়ে গিয়েছিলেন হলঘর থেকে।
নেহি বাবুজী নেহি ঝুটনবাব সাহেব রাত বারোটায়ই–
১৭. মোতির কথাটা শেষ হল না
মোতির কথাটা শেষ হল না—হঠাৎ যেন বাঘের মত গর্জন করে উঠলেন নবাব সাহেব, এই হারামজাদী—আবার মিথ্যা কথা বলছিস–
মিথ্যে ওকে শাসিয়ে কোন লাভ হবে না নবাব সাহেব সত্য তা ওর মুখ দিয়ে আগেই বের হয়ে গিয়েছে
না, না—ও বুট বলছে।
ঝুট ও বলেনি কারণ রাত দশটায় আপনি হলঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন সত্য—এবং আপনি ভেবেছিলেন সে সময়—ও আপনাকে হলঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখতে পেয়েছে আপনার গতরাত্রে হলঘর থেকে রাত দশটায় বের হয়ে যাবার সাক্ষী ও রইল। কিন্তু দুভার্গ্য আপনার, মোতি সেটা দেখতে পায়নি কারণ দেখবার মত অবস্থা তখন তার ছিল না। সিদ্ধির নেশায় জল-বৃষ্টির ঠাণ্ডায় তখন ও ঘুমিয়ে পড়েছিল—তারপর আবার আপনি ঐ হলঘরে গিয়ে যখন দ্বিতীয়বার ঢোকেন-রাত বারোটার কিছু আগে কোন এক সময় ফুপুর ঘর থেকে—এবং যে সময় আপনার গায়ে ছিল ঐ বোরখাটা—
কি—কি সব বলছেন—পাগলের মত
নবাব সাহেব প্রতিবাদ জানালেন বটে কিন্তু তাঁর গলার স্বর যেন কেমন নিস্তেজ কেমন। ঠাণ্ডা প্রতিবাদের তীব্রতা নেই সে কণ্ঠস্বরে তেমন যেন।
আমি যে মিথ্যা কিছু বা পাগলের মত কিছু এলোমেলো বকছি না আপনার চাইতে। বেশী কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয় নবাব সাহেব। শুনুন—হলঘরে ঢুকতে গিয়েই বোরখাটা আপনার পেরেকে বেঁধে ছিড়ে যায়—এবং তারপর যে কোন কারণেই হোক বোরখা খুলে। রেখে আপনি যখন পরে নিশ্চিন্তে ঘর থেকে বের হয়ে যান মোতি ঘুমিয়ে আছে ভেবে অত রাত্রে—দুভাগ্য আপনার সেই মুহূর্তে মোতির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল এবং সে আপনাকে দেখতে পায়–
কিরীটীর গলার স্বর তীক্ষ্ণ–ঋজু।
সে বলতে থাকে, ধর্মের কল এমনি করেই বাতাসে নড়ে নবাব সাহেব, এমনি করেই আমাদের গুণাহের মাশুল খোদাতালার কাছে তামাম শোধ করতে হয়, নচেৎ আপনিই বা বোরখাটা রেখে পরম নিশ্চিন্তে হলঘর থেকে বের হয়ে আসবেন কেন? আর ঠিক ঐ সময়টিতে অতিরিক্ত পরিমাণ সিদ্ধি খাওয়া সত্ত্বেও মোতির ঘুমটা ভেঙে যাবে কেন এবং আপনি ওর চোখে পড়ে যাবেনই বা কেন—আবার মেহেরউন্নিসাই বা আপনাকে বাঁচাতে কোন এক সময় আপনার ফেলে আসা বোরখাটা হলঘর থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসবেন কেন?