তবে সে কোথায় থাকত?
মেহের তো নীচের মহলেই একটা ঘরে থাকে।
আচ্ছা নবাব সাহেব—বেগম সাহেবাদের কোন মাসোহারার ব্যবস্থা নেই?
আছে বৈকি।
কত করে পেতেন তাঁরা?
সবাই মাসে হাত-খরচ পাঁচশো টাকা করে পায়—তাছাড়া প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট একটা করে আছে।
জাহানারা বেগমের সেই অ্যাকাউন্টে বোধ হয় সবার চাইতে বেশী টাকা ছিল?
হ্যাঁ।
কত আন্দাজ হবে?
তা লাখ খানেক হবে।
অত টাকা আপনি দিয়েছিলেন?
না–দিয়েছিল আমার ফুপু–আসগরী বেগম–তার ব্যক্তিগত বহু টাকা ছিল পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। মরবার আগে সাত মাস ফুপু প্যারালিসিস হয়ে পড়ে ছিল। সেই সময় জাহান তাকে সেবা করেছিল।
তাতেই বুঝি তিনি ঐ টাকা তাঁকে দিয়ে যান?
হ্যাঁ–তাই তো শুনেছি।
আপনার ব্যাক্তিগত অ্যাকাউন্টে কত টাকা হবে?
কত আর, দশ বিশ হাজার থাকে তো যথেষ্ট–ব্যবসায়ে টাকা খাটে—আসে যায়—
কিসের ব্যবসা আপনার?
প্রধানত কয়লার খনি—
আপনার কয়লার খনি আছে?
হ্যাঁ—দুটো।
১৪. রোশন আলী আপনার ছেলে
রোশন আলী আপনার ছেলে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
তিনি তো এখানে থাকেন না?
না—তাকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি—একটা স্কাউনড্রেল। রীতিমত আক্রোশ যেন ফুটে ওঠে কথা বলতে বলতে নবাব সাহেবের কণ্ঠস্বরে।
তিনি কখনো আসেন না এখানে?
না।
কিছু যদি মনে করেন তাঁর সঙ্গে আপনার মনোমালিন্য হল কেন?
তাকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করেছি—তার কথা আর বলবেন না।
আমি কিন্তু আপনার ছেলে রোশন আলী সাহেবকে চিনি।
আপনি চেনেন তাকে?
হ্যাঁ—অনেক দিন থেকেই।
আপনি চেনেন রোশনকে? আবার প্রশ্ন করেন নবাব সাহেব।
হ্যাঁ–তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্বও আছে।
ওঃ।
আচ্ছা নবাব সাহেব, আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আমরা পাশের ঘরে যাচ্ছি, যদি অনুগ্রহ করে পাশের ঘরে মেহেরকে একটিবার পাঠিয়ে দেন—
নবাব সাহেব কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, তারপর প্রশ্ন করলেন, মেহেরকে?
হ্যাঁ।
তার সঙ্গে আপনাদের কি প্রয়োজন? নবাব সাহেব আবার প্রশ্ন করেন।
তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
প্রশ্ন?
হ্যাঁ।
কি প্রশ্ন?
সে তাকেই করব।
ও–বেশ আমি তাকে ডাকছি।
নবাব সাহেব অতঃপর মেহেরকে ডাকলেন। এবং নবাব সাহেবের ডাকে মেহের একটু পরে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
মেহের, এঁরা তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করতে চান—
মেহের হাঁ বা না কোন সাড়া দিল না। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল।
আপনার নাম তো মেহেরউন্নিসা? কিরীটী প্রশ্ন করে।
মেহের পূর্ববৎ নীরব। কোন সাড়া নেই।
আপনি কাল রাত্রে আটটা থেকে দুটো পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?
মেহের পূর্ববৎ নীরব।
চুপ করে থাকলে চলবে না মেহেরউন্নিসা জবাব দিতে হবে। বলুন—কিরীটী বলে।
কোথায় আর থাকবে, বললেন নবাব সাহেব, নীচের মহলে ছিল।
না।
কিরীটীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে চকিতে ফিরে তাকান নবাব সাহেব ওর মুখের দিকে।
উনি ছিলেন আপনার ঘরে।
আমার ঘরে!
হ্যাঁ, আপনার ঘরে।
কিন্তু–
হ্যাঁ, শুধু আপনার ঘরেই নয়। কাল রাত্রে কোন এক সময় উন হলঘরেও গিয়েছিলেন আপনি হলঘর থেকে চলে আসবার পর।
হলঘরে গিয়েছিল মেহের কাল রাত্রে আমি চলে যাবার পর! কি বলছেন আপনি যা-তা। ও আগাগোড়া আমার ঘরেই ছিল।
নবাব সাহেব প্রতিবাদ জানান জোরালো গলায়।
না, সব সময় ছিলেন না, আমি বলছি।
আপনি—
এই যে দেখুন বলতে বলতে কিরীটী একটুখানি কালো রেশমী কাপড়ের অংশ পকেট থেকে বের করে নবাব সাহেবের চোখের সামনে তুলে ধরল।
১৫. নবাব সাহেব প্রশ্ন করেন
এটা—এটা কি? নবাব সাহেব প্রশ্ন করেন।
এটা কি বুঝতে পারছেন না নবাব সাহেব—এটা মেহেরউন্নিসার বোরখার একটি ছেড়া অংশ। এটা কোথায় পেয়েছি জানেন? হলঘরের মধ্যে ফুপুর ঘরের দরজার গায়ে একটা ছোট পেরেক উঠে আছে, সেই পেরেকে লেগে ছিল। সম্ভবত ঐ বাথরুম পথে আসবার বা যাবার সময় তাড়াতড়িতে বোরখাটা পেরেকে লেগে ছিড়ে যায়। আর সেই সময়
মেহেরের বোরখা? নবাব সাহেব যেন বোকার মতই প্রশ্নটা করেন।
হ্যাঁ দেখুন না-পরীক্ষা করে। ওঁর হাতের কাছে বোরখাটা—উনি হাত তুললেই চোখে পড়বে।
কেমন যেন বোকার মতই নবাব সাহেব মেহেরের দিকে তাকালেন আবার।
উনি দু-দুবার ট্রে হাতে করে এ ঘরে যখন এসে ঢোকেন তখনই আমার দৃষ্টিতে ব্যাপারটা পড়েছে।
না। এতক্ষণে মেহেরউন্নিসা কথা বলে।
সকলেই যুগপৎ ওর দিকে তাকায়।
আমার বোরখা ঘেঁড়াই ছিল, তা ছাড়া এটা আমার বোরখা নয়।
আপনার নয়?
না।
তবে কার বোরখা?
মোতির।
মোতির–মানে জাহানারা বেগমের খাস দাসীর?
হ্যাঁ।
মোতির বোরখা আপনি পরেছেন?
হ্যাঁ।
দয়া করে বোরখাখানা খুলবেন কি—
কথাটা শেষ হলো না কিরীটীর। সহসা মেহের তার মুখ থেকে বোরখাখানা তুলে ফেলল।
সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী যেন চমকে ওঠে।
এ সেই মুখ—চকিতে আরশিতে দেখা সেই অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি।
কিরীটী যেন বোবা। সত্যিই অপরূপ সুন্দরী মেহেরউন্নিসা।
বয়স খুব বেশী হবে না। চব্বিশ কি পঁচিশ—তার চাইতেও কম হতে পারে। কিন্তু ঐ মুখ—ঐ মুখখানি না হলেও ঠিক অমনি একখানি মুখ কিরীটী যেন কোথায় দেখেছে।
কোথায় কোথায় দেখেছে! হঠাৎ কি যেন একটা মনে পড়ে কিরীটীর। সে বলে, এক্সকিউজ মি—এক সেকেণ্ড—আমি আসছি।
কিরীটী দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সোজা গেল হলঘরে। ঢুকে দেখল মৃতদেহটা তখনো সেখানে তেমনিই পড়ে আছে।
মৃতার মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে কিরীটী পুনরায় নবাব সাহেবের ঘরে ফিরে এল।