বোরখার দুটি ছিদ্রপথে দুজোড়া কালো চোখ দেখা যায় স্পষ্ট।
কিরীটীর দৃষ্টির সঙ্গে যেন মিলিত হলো মুহূর্তের জন্য তারপরইবোরখা-পরিহিতা নারীমূর্তি ধীর শান্ত পায়ে ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে চলে গেল পর্দার অন্তরালে ট্রে-টা হাতে।
কিরীটী ঘুরে তাকাল নবাব সাহেবের দিকে।
প্রশ্ন করল, নবাব সাহেব—ও কি আপনার দাসী?
য়্যাঁ—
বলছিলাম ঐ মেয়েটি কে–বাড়ির দাসী?
দাসীনা না না–হ্যাঁ, মানে দাসী–না ঠিক তা নয়—
তবে মেয়েটি কে?
মেহের—মেহেরুন্নিসা—আসলে কি জানেন—ওকে আমার এ্যাটেনডেন্টও বলতে পারেন। ইদানীং ও এখানে আসবার পর থেকে আমাকে দেখাশোনা সবই ও করে।
খুব বেশী দিন বোধ হয় এখানে উনি আসেননি? কারণ কুলসম ও মোতির কাছে ওর সম্পর্কে কিছু শুনলাম না।
কিরীটী নবাব সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবার।
না, না—ও তো সব সময় এখানে থাকে না—মধ্যে মধ্যে আসে। এবারে কয়েকদিন আগে এসেছে আর যায়নি বুঝলেন কিনা যেতে দিই নি মেয়েটা আমার habits কখন কি দরকার না দরকার এসব বুঝে ফেলেছে। ও চলে গেলে আমার ভারী অসুবিধা হয়।
তা তো হবারই কথা—কিরীটী মৃদু হেসে বলে।
হ্যাঁ—মেহের ভারী বুদ্ধিমতী চালাক-চতুর—
আপনার সঙ্গে ওর কোনরকম আত্মীয়তা আছে?
আত্মীয়তা—না, না—সে রকম কিছু নেই–তবে–
তবে?
এই সামান্য পরিচয় আর কি!
কিরীটী মৃদু হাসলো।
হাসিটা এত মৃদু—এত ক্ষণস্থায়ী যে কারো নজরে পড়ে না।
নবাব সাহেব!—কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।
বলুন—
ছোট বেগম সাহেবা অর্থাৎ–জাহানারা বেগমের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনি কাউকে সন্দেহ করেন?
সন্দেহ—
হ্যাঁ–কারণ আমাদের মনে হচ্ছে—
কি—কি মনে হচ্ছে?
এই বাড়ির মধ্যে কেউ তাঁকে হত্যা করেছে। বাইরের কেউ নয়।
বাড়ির মধ্যে কেউ! কি বলছেন আপনি? কে তাকে হত্যা করবে, কেনই বা করবে?
তা জানি না, তবে আমাদের ধারণা তাই। কিরীটী বলে শান্ত কণ্ঠে।
না না—তা কি করে হবে?
আচ্ছা, আপনার ভাগ্নে নাসির হোসেন সাহেব—
নাসির!
হ্যাঁ—তাঁর সঙ্গে জাহানারা বেগমের সম্পর্কটা কেমন ছিল বলে আপনার মনে হয়?
অবিশ্যি জাহানের সঙ্গে নাসিরের এ বাড়ির মধ্যে সব চাইতে বেশী ভাব ও হৃদ্যতা ছিল, কিন্তু তাই বলে-না না, সে রকম কিছু থাকলে—
আপনি টের পেতেন—স্বাভাবিক। আচ্ছা, নাসির হোসেন সাহেবকে তাঁর সিনেমার ব্যাপারে যে বেগম সাহেবা মধ্যে মধ্যে ওঁকে অর্থসাহায্য করতেন আপনি তা জানেন?
কি—কি বললেন? জাহান নাসিরকে সাহায্য করতটাকা দিত তার সিনেমার ব্যাপারে!
আমার তাই মনে হয়।
অর্থসাহায্য করত জাহান—অথচ ঘুণাক্ষরে আমি তা জানতে পারিনি!
কথা বলতে বলতে মনে হলো যেন নবাব সাহেব রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।
কিরীটী নবাব সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
নবার সাহেব বলতে থাকেন, শয়তান—একটা শয়তান—দুমুখো সাপ—দুদিক দিয়ে শুষেছে।
১৩. এখন বুঝতে পারছি
এখন বুঝতে পারছি, কিরীটী বলে, বেগম সাহেবা তো তাঁকে অর্থসাহায্য করতেনই এবং আপনিও করতেন।
দিয়েছি, নিশ্চয়ই দিয়েছি কিন্তু ও যে জাহানের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছে বা নিচ্ছে, যদি একবারও জানতাম—এখন বুঝতে পারছি
কি বলুন তো!
ও আমার সর্বনাশ করবার জন্য সব দিক দিয়ে বদ্ধপরিকর হয়েছিল—
নবাব সাহেবের কথাটা শেষ হলো না।
বাধা পড়লোবোরখায় আবৃতা মেহের পুনরায় ঘরে এসে প্রবেশ করে নবাব সাহেবের সামনে ট্রে ধরল।
ট্রেতে কাঁচের গ্লাসে পূর্বের মত সোনালী তরল পদার্থ।
কিরীটীর মনে হলো যেন ঠিক ঐ সময়—ঐ মুহূর্তে ঐ পানীয়ের জন্য নবাব সাহেব প্রস্তুত ছিলেন না। ঐ সময় ঐ পানীয় যেন অপ্রত্যাশিত—একটু যেন থতমত খেয়ে গেলেন।
পানীয়া গ্রহণ করবেন কি করবেন না সে কারণে যেন খানিকটা দ্বিধাও প্রকাশ পায়। তারপরই মনে হলো মেহের যেন চাপা স্বরে নবাব সাহেবকে কি ফিস ফিস করে বললে।
নবাব সাহেব বারেকের জন্য একবার আড়চোখে—যেন মনে হলো ঘরের মধ্যে বিশেষ করে প্রশ্নকারী কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, তারপর হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক চুমুকে পানীয়টা নিঃশেষ করে গ্লাসটা আবার ট্রের উপরে নামিয়ে রাখলেন।
মেহের পুনরায় ধীর পদে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা।
মিঃ চ্যাটার্জী—মানিকবাবু—
নবাব সাহেবের ডাকে চ্যাটার্জী মুখ তুলে তাকালো।
আমার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন—এবারে যদি আপনারা এ ঘর থেকে যান তো আমি একটু বিশ্রাম নিতে পারি–
নিশ্চয়ই। আপনাকে আমরা আর বেশীক্ষণ বিরক্ত করব না নবাব সাহেব—আর দু-চারটে কথা আমাদের জানবার আছে, জানা হলেই আপাতত আপনাকে আর আমাদের প্রয়োজন হবে না।
কিরীটী কথাগুলো বললে।
নবাব সাহেব কিরীটীর মুখের দিকে পুনরায় তাকালেন।
কাল রাত্রে কখন আপনি হলঘর থেকে বের হয়ে আসেন?
আমি?
হ্যাঁ।
তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম—বোধ হয় তখন রাত দশটা হবে–
আপনি যখন হলঘর থেকে উঠে আসেন ছোট বেগম সাহেবা তখন সে ঘরে তাহলে একাই বসে গান গাইছিলেন?
হ্যাঁ।
গানের মাঝখানে উঠে চলে এলেন, বেগম সাহেবা কিছু বলেননি?
না—সে-ই তো বলেছিল উঠে আসতে–
হুঁ–আচ্ছা বাইরে দাসী মোতিকে আপনি বসে থাকতে দেখেছিলেন কি ঐ সময়?
ঠিক লক্ষ্য করিনি।
ফিরে এসে আপনি কি করলেন?
শুয়ে পড়ি।
সঙ্গে সঙ্গেই?
হ্যাঁ।
মেহের তখন কোথায় ছিল?
মেহের—মেহের আমার ঘরেই ছিল।
রাত্রে বুঝি মেহের আপনার ঘরেই থাকত?
হ্যাঁ—মানে–না, মেহের আমার ঘরে থাকবে কেন?