কিরীটীর একপাশে রাজু, অন্যপাশে সুব্রত।…কিরীটী দুহাতে দুজনকে ইশারায় চুপচাপ থাকতে বললে।
দেখা গেল সরু সরু প্যাঁকাটির মত আঙুল-বিশিষ্ট একটা ছোট হাত ধীরে ধীরে স্কাইলাইটের শিকটা চেপে ধরল।…ক্রমে আরো একটা হাত তারই পাশে, নজরে পড়ল ওদের।
একসময় ডানহাতটা সরে গেল, এবং অল্পক্ষণ পরেই সেই হাতটা আবার দেখা গেল। এবারে দেখা গেল, সে হাতে একটা ছোট চৌকো বাক্স ধরা আছে।
আস্তে আস্তে হাতের উপর ভর দিয়ে সেই নিশাচর মূর্তি, বাঁদরের মত অদ্ভুত কায়দায় পাক খেয়ে, ফাঁক দিয়ে মাথা ও দেহের অর্ধেকটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিল।
তারপরই মেঝের উপরে কিছু যেন পড়ার শব্দ পাওয়া গেল।
ঘরের মাঝে যেটুকু চাঁদের আলো এসেছে, তা কম হলেও যথেষ্ট। সেই আলোয় দেখা গেল, বাক্সটা থেকে বের হয়ে একটা অদ্ভুত কুৎসিত-দর্শন ইঞ্চি ছয়েক লম্বা ঘোর লাল রঙের পোকা তার বাঁকানো রোমশ বড় বড় তারের মত সরু সরু ঠ্যাং দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, টেবিলটার পায়ার গা বেয়ে সেই বিষাক্ত-গন্ধী থামটার দিকে চলেছে।
কিরীটী ক্ষিপ্রহন্তে গায়ের জামাটা খুলে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে একটা লাফ দেওয়ার অস্পষ্ট শব্দ পাওয়া গেল। তারপর কিরীটী ছুটে রাস্তার ধারের জানলার দিকে গেল। চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল—একটা কালো রঙের গাড়ি চলে যাচ্ছে।
সুইচ টিপে আলোটা জ্বালতে জ্বালতে কিরীটী বললে, পাখী পালিয়েছে। চল, মৃত্যুদৃতকে ভাল করে দেখা যাক।
বলতে বলতে কিরীটী টেবিলের ধারে এগিয়ে গেল ওবং টেবিলের জামাটির ওপর একটা লাঠি দিয়ে গোটাকয়েক ঘা দিয়ে জামাটা তুলতেই পরিপূর্ণ আলোকে দেখা গেল, লাল রংয়ের একটা পোকা। পোকাটা একটা বড় পিঁপড়ের মত দেখতে। তার মস্ত মস্ত দুটো শুড়। আর সেই শুড়ের গায়ে ছোট ছোট সব লোম। মাথার অনুপাতে দেহটা বেশ বড় এবং অসংখ্য সরু সরু কম্পমান পা।
কিরীটী পোকাটার দিকে চেয়ে বললে, এই তাহলে মৃত্যুদূত। যতদূর মনে হয়, এই পোকাটা Scolopendra গ্রুপের। এখন বুঝতে পারছি-মিঃ দাসের চাকর সুখলাল যে বলেছিল, মিঃ দাস অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, লাল বাঁকা বলে একটা কথা—সেটা তিনি লাল বাঁকা বলেননি, বলেছিলেন লাল পোকা এবং সেটা এই রকম একটা পোকা দেখেই।
তার ঘরে যে সিল্কের সুততা পাওয়া গেছল, সেটা দিয়ে এইরকম একটি পোকাকেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে মারবার জন্য। কিন্তু প্রথমবারের চেষ্টা নিষ্ফল হয়; সেইজন্য বোধ হয় দ্বিতীয় চেষ্টা করতে হয়েছিল।
মিঃ দাসের অফিস-ঘর থেকে মাত্র হাত-তিনেক ব্যবধানে গলির অন্য দিকে ছিল সেই পাঞ্জাবী ডাক্তারের বাড়ি। ডাক্তারের বাড়ির দোতলার ছাদে উঠে নিরিবিলিতে স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে এই মরণ-পোকাকে সুতোর সাহায্যে প্রেরণ করা এমন কোন দুরূহ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু একটা জিনিস আমার হিসাবে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, মিঃ দাসকে হত্যা করার মধ্যে কি এমন কারণ থাকতে পারে? রক্তমুখী ড্রাগন তো ওঁকে হত্যা না করেও অনায়াসেই কাজ হাসিল করতে পারত, যেমন করে মিঃ চিদাম্বরকে লুকিয়ে ফেলে কাজ হাসিল করে নিয়েছে।
তার মানে? কি করে জানলে তা? তাছাড়া চিদাম্বরমকে লুকিয়ে রেখেছে, এখবর কি করে জানলে কিরীটী? আগ্রহে উদগ্রীব হয়ে সুব্রত জিজ্ঞেস করলে।
কিরীটী বললে, মিস্টার রামিয়ার কাছ থেকে আজই সকালে খবর পেয়েছি—চিদাম্বরমের সেক্রেটারীর কাছে রক্তমুখী ড্রাগনের এক পরোয়ানা এসেছে-একটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে এক লাখ টাকা না দিতে পারলে, চিদাম্বরকে তারা পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে ফেলতেও পশ্চাৎপদ হবে না, এবং নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে টাকা পেলে, চিদাম্বরমকে তারা ফিরিয়ে দেবে অক্ষত দেহে; সে প্রতিশ্রুতিও সেই চিঠির মধ্যে আছে।
০৬. কিরীটী, সুব্রত ও রাজু
পরদিন সকালবেলা কিরীটী, সুব্রত ও রাজু গতরাত্রের ঘটনা সম্পর্কেই আলোচনা করছিল।
কিরীটী বললে, যে কুৎসিত মুখটা স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে দেখা দিয়েছিল সেটা মনে হয় একটা বাঁদরের মুখ।
সুব্রত বললে, আমারও তাই এখন মনে হচ্ছে। মুখখানা আমি ভাল করেই দেখেছি। সেটা বাঁদর-জাতীয় কোন প্রাণীর মুখ বলেই মনে হয়।
কিরীটী বললে, আরেকটা কথা সুব্রত—এই দলের যিনি নেতা, অর্থাৎ যিনি মহামান্য রক্তমুখী ড্রাগন নামে পরিচিত, তিনি আমার মনে হচ্ছে হয়ত একজন চায়নীজ–
চায়নীজ!
কিরীটী বললে, তোদের বলিনি-যে বাক্সটার মধ্যে ঐ পোকাটা ছিল—তার মধ্যে একটা কাগজ ছিল?
কাগজ?
হ্যাঁ, চীনা ভাষায় লেখা কাগজটা—তাই আমি ভেবেছি কাগজটার মধ্যে কি লেখা আছে জানতে হবে—আর তাই চীনা ভাষা পড়তে পারে এমন একজন লোকের কথা রামিয়াকে বলেছি–
তারপর একটু থেমে আবার কিরীটী বললে, ঐ রক্তমুখী ড্রাগন যেই হোক, যতই তার কথা ভাবছি মনে হচ্ছে, লোকটা রসায়নশাস্ত্রে পণ্ডিত, ইংরেজীতে পণ্ডিত, বাঁদর দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে, বিশালকায় পিঁপড়ের মত জীবকে বিষাক্ত গন্ধে মাতোয়ারা করে মানুষের রক্তপানে লোলুপ করতে পারে। হয়ত কোন ক্ষুদ্র জীবকে ঘরের মধ্যে পাঠিয়ে তাকে বিষাক্ত গন্ধে উম্মত্ত করে ফেলে, এবং তারই কামড়ে নিদ্রিত মানুষকে অচৈতন্য করে দিতে পারে।
দুপুরের দিকে মিঃ রামিয়া এসে হাজির হলেন।
কিরীটী তাকে এনে ঘরে বসাল।
কিরীটী বললে, মিঃ রামিয়া, আমি যে একজন শিক্ষিত চীনা লোকের কথা বলেছিলাম, তিনি কোথায়?