সুন্দর দাসের ঘরে কিরীটী যে বিষাক্তগন্ধী খামখানা পেয়েছিল, পকেট থেকে সেখানা বের করে সে টেবিলের উপর রাখল। তারপর সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বলল, আজ রাত্রে এটা এই টেবিলেই রইল—দেখা যাক কিছু ঘটে কিনা।
সুব্রত বলল, কি ঘটবে, কিরীটী?
ঈষৎ হেসে কিরীটী বলল, বলিনি বুঝি তোমাকে? আজ আবার রক্তমুখী ড্রাগন আমাকে শাসিয়ে গিয়েছে।
তাই নাকি?
কিরীটী বলল, হ্যাঁ, রক্তমুখী ড্রাগন আজই দুপুরবেলায় একটা লোক মারফৎ একখানা কিরীটী চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছে যে, সেদিন পিস্তলের গুলিতে যদিও আমরা অনুসরণকারীকে নিরস্ত করেছিলাম, তাহলেও সে আমাদের নাম-ধাম-ঠিকানা সব কিছু জানতে পেরেছে।
সে বলে পাঠিয়েছে যে, প্রায় আমারই চোখের উপর, মানে আমার উপস্থিতির সময়েই সে সুন্দর দাসের দফা শেষ করেছে অথচ আমরা তার কিছুই কূলকিনারা করতে পারিনি, পারবও না। কাজেই সে উপদেশ দিয়েছে, আমরা যেন বাড়ি ফিরে যাই; নইলে অতি শীগগিরই সে আমাদেরও দফা শেষ করবে।
তারপর একটু থেমে বললে, আমার আশঙ্কা হচ্ছে, রক্তমুখী ড্রাগন আজই আমাদের উপরে একটা attempt নেবে হয়ত। কারণ এমনি ধরনের খুনেদের স্বভাবই এই যে, তারা শাসানি যাকে দেয়, তাকে সময় দেয় খুবই কম,-কখনও বা একেবারেই সময় দেয় না;শত্রুকে তৈরী হবার সুযোগ দেবার পক্ষপাতী তারা একেবারেই নয়। আজ শাসানি দিয়েছে, হয়ত আজই তা কাজে পরিণত করবার চেষ্টা করবে। কাজেই আমিও আজ পরীক্ষার জন্য তৈরী হয়ে আছি।
কি রকম? কোন পাহারা রাখলে না, কিছুই করলে না-আলোটা পর্যন্ত নিবিয়ে দিলে। অথচ আশঙ্কা করছ, আজই শত্রুপক্ষ কিছু করে ফেলতে পারে! আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে কই?
সুব্রতর কণ্ঠস্বর একটু ক্ষুব্ধ।
একটু হেসে কিরীটী বলল, আছে আছে। এই নাও না আত্মরক্ষার জিনিস!
এই বলে সে পকেট থেকে একটা শিশি বের করে, সেই শিশির আরক প্রত্যেকের হাতের পাতায় ঢেলে দিল। আরকের তীব্র ঝাঁঝাল গন্ধে বোঝা গেল, সেটা এমোনিয়া সলুশন।
বেশ করে হাতে ঘষে নাও।
সকলে কিরীটীর কথামত কাজ করল।
আবার সুব্রত বলল, আত্মরক্ষার চমৎকার জিনিস বের করেছ তো কিরীটী!
রক্তমুখী ড্রাগন-এর দেওয়া বিষাক্তগন্ধী খামের ষড়যন্ত্র এড়াতে হলে, মনে হয় এই হচ্ছে একমাত্র ওষুধ।
সুব্রত বলল, একটা কথা কিরীটী, অবিশ্যি রক্তমুখী ড্রাগন নামটার মধ্যেই একটা বিভীষিকা ও সেই সঙ্গে রহস্যের ইঙ্গিত আছে এবং চিদাম্বরম ও সুন্দর দাস দুজনেই রক্তমুখী ড্রাগন- এর শিকার। রক্তমুখী ড্রাগন তোকে যে চিঠি দিয়ে শাসিয়েছে তাতে করে যেন আমার মনে হচ্ছে এর সব কিছুর পিছনে একটা দুর্ধর্ষ দল আছে এবং তাদের একটা বিশেষ উদ্দেশ্যও আছে।
কিরীটী বললে, ঠিকই অনুমান করেছিস। আমার তো অনুমান তাই।
একটা কথা কিরীটী—
কি?
ঐ বিষাক্ত গন্ধের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছুর ইঙ্গিত আছে মনে হয়। তাই।
কিন্তু গন্ধটা–
অনেকদিন আগে, মনে পড়ে এক পর্যটকের বইতে পড়েছিলাম, তিনি বর্মার জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে একসময় এক ধরনের অদ্ভুত বুনো ফুল দেখেছিলেন, সেগুলো দেখতে অনেকটা সবুজ রংয়ের। সেই ফুলের গন্ধ ভারী অদ্ভুত; যেমন তীব্র, তেমনি ন্যক্কারজনক। সমস্ত শরীরের মধ্যে কেমন যেন এক ঝিম্ ঝিম্ ভাব আনে। এবং ঐ ফুলের গন্ধের এমন একটা আশ্চর্য শক্তি আছে যে, কোন বস্তুতে যদি একবার গন্ধটা লাগে, তার গায়ে যেন একেবারে জড়িয়ে যায়। গন্ধটার একটা অত আকর্ষণী শক্তিও আছে। এই বিষাক্ত গন্ধেই আকৃষ্ট হয়ে এসে মৃত্যুদূত প্রথমে ছুটে যায় সেই বিষাক্তগন্ধী জিনিসটার দিকে। সম্ভবত বিষাক্ত গন্ধের উত্তেজনায় তার রক্তলালসা জেগে ওঠে, তারপর নিকটবর্তী যে কোন লোকের রক্তপান করবার জন্য সে অতি নিঃশব্দে তার গলদেশে বিষ-দত্ত ফুটিয়ে দেয়-মরণের বিষাক্ত-চুম্বনে সে হতভাগ্য আর কোনদিনই জাগে না।
কথা বলতে বলতে শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠস্বর কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হয়।
চুরেটের ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে কিরীটী আবার বলল, মনে পড়ে সুখলাল বলেছিল, দিতিনেক আগে এক রাত্রে মিঃ দাস হঠাৎ ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন?…আমার মনে হয় ভয় পেয়েছিলেন ঐ বিষাক্ত গন্ধলোভী কুৎসিত-দর্শন মৃত্যুদূতকে ঘরে চোখের সামনে দেখে।
মৃত্যুদূত?
হাস্-স্-স্ …চুপ!..
বলেই কিরীটী তার ঠোটের ওপর তর্জনী-আঙুলটা রেখে সবাইকে নীরব হবার জন্য সঙ্কেত করল। সকলেই তার সঙ্কেত মেনে তৎক্ষণাৎ চুপ করে গেল।
বাইরে একটা মৃদু খসখস্ শব্দ। একটা অজানিত আশঙ্কা, একটা অস্বাভাবিক অশরীরী বিভীষিকা যেন অক্টোপাশের মত তার বাহু প্রসারিত করে অন্ধকারে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে।
নীচের বৈঠকখানার ওয়াল-ক্লকটায় ঢং ঢং করে রাত্রি দুটো ঘোষণা করল।
যে টিবিলটার ওপরে কিরীটী সেই বিষাক্ত-গন্ধী খামখানা রেখেছিল, সেই টেবিলটা তুলে নিয়ে সে নিঃশব্দ পায়ে উঠে বাগানের দিকটার দেয়ালে একটু তফাতে রেখে ফিরে এল।
সব চুপচাপ বসে। অন্ধকারে প্রত্যেকের নিঃশ্বাসের শব্দ নিঃশব্দে যেন চাপ বেঁধে উঠছে।
আকাশে চাঁদ উঠেছে, তারই আলো এসে স্কাইলাইটের ফাঁক ও খোলা জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
একটা অস্পষ্ট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাগানের দিককার দেয়ালে লতিয়ে-ওঠা আইভিলতার পাতায় পাতায় বুঝি একটুখানি মৃদু শব্দ শোনা গেল। তারপরই অস্পষ্ট একটা আবছা কালো ছায়া স্কাইলাইটের উপরে জেগে উঠল। একটা ফ্যাকাশে রংয়ের বিশ্রী কুৎসিত চ্যাপটা মুখ ধীরে ধীরে স্কাইলাইটের ফাঁকে দেখা দিল।