কিরীটী বলল, দেখলেন মিঃ রামিয়া। ওটা শত্রুর গাড়ি তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ওর উদ্দেশ্য ছিল কেবল অনুসরণ করা। যখন ধরা পড়ে গেল তখন আর বৃথা বিপদের ঝুঁকি ওই বা নেবে কেন? তাই পালিয়ে গেল।
তারপর কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।
হঠাৎ কিরীটী নীরবতা ভেঙে বলল, মিঃ রামিয়া, চিদাম্বরমের ব্যাপারটা আপনার মনে। আছে তো?
আছে বৈকি! কিন্তু সে-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন, মিঃ রায়?
কিরীটী বলল, চিদাম্বরমের সেই ঘটনা আর সুন্দর দাসের ব্যাপারটা। দুটো ঘটনার মধ্যে বৈশিষ্ট্য বা সামঞ্জস্য লক্ষ্য করেছেন কি?
কি বলুন তো!
কিরীটী বলল, দুটো ব্যাপারেই ঘরের স্কাইলাইট থেকে একটা সুতো ঝুলছে, দেখা গেছে।
মিঃ রামিয়া বললেন, হ্যাঁ, সে-কথা ঠিক। কিন্তু–
কিরীটী বলল, এই সুতোর ব্যাপার থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, ঐ দুটির নায়ক একই ব্যক্তি সম্ভবতঃ এবং নায়ক যে-ই হোক না কেন, তার এই অপকার্যে তাহাকে সাহায্য করেছে অতি ক্ষুদ্র কোন জিনিস, সে জিনিসটা নির্জীব কোন জড়পদার্থ হতে পারে, অথবা সজীব কোন ক্ষুদ্র প্রাণী—যেমন কোন পোকা-মাকড়ও হতে পারে।
মিঃ রামিয়া বললেন, ঠিক বুঝলাম না—ক্ষুদ্র প্রাণী বা পোকামাকড়-কি বলতে চাইছেন?
মৃদু হেসে কিরীটী বলল, বেশ, তাহলে আরও একটু খুলে বলছি। ওপর থেকে ঘরের ভিতর সুতো ঝুলিয়ে দেওয়াটা-আমার মনে হচ্ছে কোন সজীব বা নির্জীব জিনিস সেই সুতোয় বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল; তারপর যেই কাজ সিদ্ধ হয়ে গেছে, অমনি সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে তুলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জিনিসটা তুলে নিয়ে গেলেও সুতোটা থেকে গিয়েছে। হয়ত সুতোটার কথা সে ভাবেনি বা সেটা নিয়ে যাবার কোন প্রয়োজন বোধ করেননি।
বহুক্ষেত্রেই।
আরও একটু খোলসা করে বলুন মিঃ রায়।
কিরীটী বললে, মনে করুন অপরাধী সুতোর সাহায্যে চিদাম্বরমের বেলায় এমন একটা জিনিস,-সজীব বা নির্জীব,-ঘরের ভিতর নামিয়ে দিয়েছিল যে, যার ফলে চিদাম্বরম অজ্ঞান। হয়ে যান, তারপর সেই অচৈতন্য চিদাম্বরমকে কেউ বা কোন একদল লোক চুরি করে নিয়ে গেছে। আর সুন্দর দাসের বেলায় হয়ত সেই সুতোয়-বাঁধা জিনিসটা ঘরে পৌঁছে সুন্দর দাসের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারপর একটু থেমে বললে, মিঃ রামিয়া এটাও জানেন-ক্লোরোফর্ম জাতীয় জিনিসে লোক অজ্ঞান হয়ে যায়, আর অতি সূক্ষ্ম সাপের কামড়েও লোক মারা যেতে পারে—
মিঃ রামিয়া চিন্তিতভাবে একটা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, তা অবিশ্যি পারে।
খানিক পরে তিনি সহসা নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মিঃ রায়, তাহলে এই অপরাধীর সম্পর্কে আপনার ধারণা কি? কোন্ জাতীয় লোক সে?
কিরীটী বলল, এই মুহূর্তে তার সঠিক জবাব দেওয়া শক্ত। তবু যতটা মনে হচ্ছে, বলছি। সাধারণ চোর-ছ্যাচোড় নয় এমন একজন যার রাসায়নিক চিকিৎসা বা বিষ-বিজ্ঞান (Toxicology) সম্বন্ধে প্রচুর জ্ঞান আছে। শুধু তাই নয়, লোকটার হয়ত প্রাণিবিজ্ঞান সম্পর্কেও যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি আছে।
ঐ ধারণা কেন আপনার হল বলুন তো? ইন্সপেক্টর মিঃ রামিয়া জিজ্ঞেস করলেন।
কিরীটী বলল, কেন বলছি, শুনুন। পুলিস-রেকর্ডে আপনিই লিখে রেখেছেন যে, চিদাম্বরমের দরজার বাইরে কিছু পায়ের দাগ দেখতে পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই পায়ের দাগগুলোর মাঝে একজোড়া পায়ের দাগ ছিল খুবই ছোট-মানুষের পায়ের দাগ বলে মনে হয় না। তাই না মিঃ রামিয়া?
হ্যাঁ।
বেশ, তাহলে কি এই স্বভাবতঃ মনে হয় না যে, তাদের দলে কোন মানুষ ছাড়াও সেই প্রাণীও আছে। এবং ঘরের ছাদ থেকে সুতো বেঁধে যে জিনিসটা নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সে-জিনিসটাও সম্ভবতঃ কোন সজীব জিনিস—অর্থাৎ প্রাণী। কারণ প্রাণী ছাড়া অপর কোন নির্জীব জিনিসের পক্ষে সুন্দর দাসকে হত্যা করা সম্ভব বলে মনে হয় না। বিশেষতঃ সুন্দর দাসের গলার কাছে ছোট ছোট কয়েকটা রক্তবিন্দুর মত দাগও দেখা গেছে। তা থেকে যদি মনে করা যায় যে, ঐ দাগগুলো কোন প্রাণীর দংশনের দাগ, আর ঐ প্রাণীটাকে। নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল সুতো বেঁধে!
মিঃ রামিয়া আর কোন জবাব দিলেন না। তিনি চুপ করে রইলেন।
গাড়িটা ততক্ষণে জীবনবাবুর বাড়ির দোরগোড়ায় এসে পড়েছিল।
জীবনবাবু তখনও বৈঠকখানায় ওদের অপেক্ষায় জেগে বসে সুব্রতর সঙ্গে গল্প করছিলেন।
কিরীটী ও রাজু ঘরে ঢুকতেই জীবনবাবু বললেন, ব্যাপার কি হে? এর নাম তোমার একটু ঘুরে আসা?
তুমি এখনও আমাদের অপেক্ষায় বসে আছ, জীবন? বড় অন্যায়। কত রাত হয়ে গেছে।
বেশ! অতিথি অভুক্ত, এখনও ফিরল না, আর আমি খেয়ে শুয়ে পড়ব?
চল, আর দেরি করে লাভ নেই।
সকলে খাওয়ার ঘরের দিকে চলল।
০৫. পরের দিন রাত্রে
পরের দিন রাত্রে।
জীবনবাবুর বাড়িটা রাস্তার একেবারে শেষপ্রান্তে।
বাড়ির পেছনদিকে একটা ছোটখাটো সিনামোনের বাগান।
বাগানের দিককার একটা ঘরে কিরীটী ও তার বন্ধুদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। ঘরে গোটা-চারেক জানলা—প্রত্যেকটাই গরাদহীন। বাইরের দেয়ালটা আইভিলতায় একেবারে ছেয়ে গেছে। চারিদিককার দেয়ালে চারটে স্কাইলাইট।
স্কাইলাইটগুলো রেকট্যাঙ্গুলার সাইজের এবং বেশ বড়, একজন মানুষ অনায়াসেই গলে যাতায়াত করতে পারে।
প্রত্যেক খাটে দুজন করে,-দুটো খাটে চারজন শোয়। ঘরের এক কোণে দেওয়াল ঘেঁষে একটা আলমারি বইয়ে একেবারে ঠাসা।
এক কোণে ঘোট একটা টেবিল, দুটো সোফা ও গোটা-কয়েক চেয়ার।