দূরের গ্যাসপোস্ট থেকে একটুখানি আলো অস্পষ্ট ভাবে এদিকে এসে পড়েছে। সেই স্বল্পালোকে রাজু খামখানা চোখের সামনে তুলে ধরল।
ঠিক সেই সময় পিছন থেকে একটা অস্পষ্ট চাপা হাসির শব্দে রাজু চমকে পিছন ফিরে তাকাল।
০৪. ভয় পেলি
ভয় পেলি? আমি কিরীটী।
না।
খামটা দে। ওটা তোমার জন্য নয়। আমার উদ্দেশে ওটা প্রেরিত হয়েছে।
মানে তোমার কথা তো আমি বুঝতে পারছি না কিরীটী!
ঐ খামখানা রক্তমুখী ড্রাগন-এর কাছ থেকে এসেছে। প্রেরক আমার কাছেই খামখানা পাঠিয়েছে এবং এর থেকে একটা দিক আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। শুঁকে দেখ।
কিরীটী খামখানা রাজুর হাত হতে নিয়ে তার নাকের কাছে তুলে ধরল।
ঠিক সেইরকম তীক্ষ্ণ অথচ অস্পষ্ট বিষাক্ত গন্ধ। গা ঘিনঘিন করে। কিরীটী পরক্ষণেই পকেট থেকে সুন্দর দাসের ঘরে পাওয়া ড্রাগন-চিহ্নিত খামখানি বের করে বলল, দুটোর গন্ধ মিলিয়ে দেখ, একই রকম কিনা!
দুটো খামের গন্ধ মিলিয়ে রাজু বলল, তাই তো?
চল, আর একবার মিঃ দাসের মৃতদেহটা ভাল করে দেখতে হবে।
চল—
ওরা আবার সুন্দর দাসের গৃহে এসে প্রবেশ করল।
স্থানীয় পুলিস-সার্জেন সবে তখন মৃতদেহ পরীক্ষা শেষ করে ইনসপেক্টর রামিয়ার সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। কিরীটীকে ঘরে ঢুকতে দেখে রামিয়া কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ রায়, ডাক্তার বলছেন, মিঃ দাস নাকি হার্টফেল করে মারা গেছেন।
কিরীটী ঝুঁকে পড়ে তীব্র আলোয় আর একবার সমস্ত দেহটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল।
ঐ সময়ই তার নজরে পড়ল মৃতদেহের গলার কাছে কয়েকটা ছোট ছোট রক্তের বিন্দুর মত দাগ। দেখতে অনেকটা উঁচ কিংবা ঐজাতীয় কোন কিছু দিয়ে বিধানোর মত ক্ষত। এছাড়া আর কোথাও তেমন কিছু চিহ্ন পাওয়া গেল না।
মিঃ রায়, আপনার কি মনে হয়? রামিয়া প্রশ্ন করলেন।
আমার? কিরীটী একটা চুবরাট ধরাতে ধরাতে নিভন্ত কাঠিটা ফুঁ দিয়ে নিভুতে নিভৃতে বলল, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, মিঃ দাস হার্টফেল করে মারা যাননি। তাকে খুন করা হয়েছে।
আপনার এ অনুমান মিথ্যাও তো হতে পারে? রামিয়া বললেন।
হতে পারে; কিন্তু সে সম্ভাবনা খুবই কম মনে হয়।
অতঃপর সুখলালকে প্রশ্ন করা হলে সে বললে-বেলা তখন পৌনে-পাঁচটা আন্দাজ হবে, একজন চীনা লোক নাকি বাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসে কি একটা জরুরী চিঠি নিয়ে। চীনাটাকে বাবুর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল সে। সুখলাল বলতে লাগল, লোকটা বাবুর সঙ্গে দেখা করে চলে যাবার পর আমি তখনও সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি, এমন সময় হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে পেছন ফিরে তাকালাম। দেখি, বাবু দরজা খুলে ছুটে বাইরে আসছেন। সমস্ত চোখমুখ জুড়ে যেন একটা ভীষণ আতঙ্ক! আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে বাবুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম, এবং বাবুকে ধরে নিয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে সোফার উপর বসিয়ে দিলাম। বাবু তখন হাঁপাচ্ছেন। আমাকে হাত নেড়ে ঘর থেকে চলে আসতে বললেন। ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি, শুনলাম বাবু অস্পষ্ট স্বরে যেন বলছেন, লাল বাঁকা!
আচ্ছা, আজকের সন্ধ্যার এই ঘটনা ছাড়া আর কোনদিন কিছু ঘটেছিল কি সুখলাল?
না, এমন বিশেষ কিছু ঘটেনি। তবে পরশু রাত্রে তখন প্রায় দশটা কি এগারোটা হবে, বাবু অফিস ঘরে কাজ করছিলেন, সেক্রেটারী বাবুও চলে গেছেন—বাবু সাধারণতঃ একটু বেশী রাত পর্যন্ত জেগেই কাজ করতেন। বাবুর কাজ সারা হলে, শোবার পর আমি শুতে যাই-বাইরের বারান্দায় বসে আছি এমন সময় হঠাৎ দরজা খুলে বাবু বেরিয়ে এলেন, মনে হল তিনি যেন খুব ভয় পেয়েছেন। বাবু বললেন-সুখলাল, আমার ঘরটা একটু ভাল করে খুঁজে দেখতে! মনে হচ্ছে কিছু যেন ঘরের মধ্যে লুকিয়ে আছে।
কিছু জিনিস, না কোন লোক লুকিয়ে আছে তিনি বলেছিলেন? কিরীটী প্রশ্ন করল।
কিছু জিনিস তিনি বলেছিলেন!
তারপর?
আমি ঘরের মধ্যে ঢুকে সব খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না।
মিঃ রামিয়ার গাড়ি বাইরে অপেক্ষা করছিল। রামিয়া কিরীটীর দিকে চেয়ে বললেন, রাত্রি অনেক হয়েছে, মিঃ রায়। আপনাকে একটা লিট দিয়ে যাব কি?
কিরীটী বললে, যদি অসুবিধা না হয়
না, অসুবিধা কি। চলুন।
গাড়ির পিছনের সীটে রামিয়া, কিরীটী ও রাজু বসল। গাড়ি তখন চলতে আরম্ভ করেছে।
কিরীটী চাপা স্বরে রাজুকে বলল, পেছনের কাচ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখ তো, কোন গাড়ি আমার পিছু নিয়েছে কি?
রাজু দেখল, একটা কালো রংয়ের মোটরগাড়ি মাত্র হাত পাঁচেক তফাতে নিঃশব্দে রামিয়ার গাড়ির পিছু-পিছু আসছে।
মিঃ রামিয়া বললেন, বটে, আমার পিছু লাগা! দাঁড়াও, আমি দেখাচ্ছি মজা!..বলেই তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াতে উদ্যত হলেন।
বাধা দিয়ে কিরীটী বলল, সে চেষ্টা করবেন না মিঃ রামিয়া। তাতে বিপদ হতে পারে।
বিপদ!
হ্যাঁ। মৃদু হেসে কিরীটী বলল, মিঃ রামিয়া, সাধ করে বিপদ ডেকে এনে কোন লাভ নেই। অতি সহজে যদি কার্যোদ্ধার হয়, তাহলে শখ করে বিপদের মুখোমুখি হওয়ার মানেই হচ্ছে একটা গোঁয়ার্তুমি।
মিঃ রামিয়া বললেন, সহজেই কার্যসিদ্ধি। আমি ঠিক বুঝলাম না আপনার কথাটা।
কিরীটী বলল, গাড়িটার গতি একটু কমিয়ে দিন। তারপর ঐ গাড়িখানার মাথার ওপর দিয়ে দুটো গুলি ছুঁড়ুন। দেখুন না, ব্যাপারখানা কি হয়!
কিরীটীর কথার কোন প্রতিবাদ না করে মিঃ রামিয়ার পিস্তল দু-দুবার দম দম্ করে গর্জন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে পেছনের গাড়িটা থেমে গেল; তারপর ক্যাচ করে একটা আওয়াজের সঙ্গে গাড়িখানা পেছনে হটে গেল এবং দেখতে দেখতে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেই দিকে তীরবেগে ছুটে পালিয়ে গেল।