কিন্তু কি আশ্চর্য! যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই ছোকরাটা চট করে মাটি থেকে উঠে পড়েই কিরীটীর কাছে এগিয়ে এল। তারপর কিরীটী কোন কিছু বোঝবার আগেই সে হাত বাড়িয়ে তাকে একখানি চিঠি দিয়ে বলল, আপনার একখানি চিঠি স্যার, এই নিন।
চিঠিখানি সে কিরীটীর হাতে একরকম গুঁজে দিয়েই, পরমুহূর্তে রাস্তার অপর পাশে ছুটে গেল যেন।
কিরীটী দেখতে পেল, ছোট একখানা মোটরগাড়ি রাস্তার উল্টোদিকে অপেক্ষা করছিল। ছোকরাটি তাড়াতাড়ি গাড়ির ভিতর উঠে বসতেই গাড়িটা যেন বায়ুবেগে দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিরীটী আবার নিজের গাড়িতে উঠে বসল, ঐ ঘোট গাড়িখানাকে তাড়া করে অনুসন্ধান করা সম্পূর্ণ বৃথা—এই সহজ সত্যটা স্পষ্ট অনুভব করে ড্রাইভারকে আবার গাড়ি চালাতে বলল।
ড্রাইভার জীবনবাবুর বাড়ির দিকে গাড়ি চালিয়ে দিল। সুব্রত বললে, চিঠিখানা পড়লে না কিরীটী? কিরীটী জবাব দিল, ও আমি দেখে নিয়েছি তক্ষুনি। চিঠিখানায় আমাকে একটু শাসানো হয়েছে। দেখতে চাও? দেখ।
কিরীটী চিঠির ভাঁজখানা খুলে ফেলল। সুব্রত দেখল, চিঠিতে লেখা রয়েছে–
মিঃ রায়,
তুমি সুচতুর গোয়েন্দা জানি। তবু তোমাকে অনুরোধ করছি—এসব ব্যাপারে তুমি নিজেকে জড়িত করো না। আরো একটা কথা, তোমার বোধ হয় জানা ভাল-তুমি যার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে যাচ্ছ, সে আর কেউ নয়—সে রক্তমুখী ড্রাগন। এর পরেও যদি তুমি চিদাম্বরমের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে যাও, তবে জেনে রেখো রক্তমুখী ড্রাগন তোমাকেও ক্ষমা করবে না।
সুব্রত খানিকটা চিন্তিতভাবে বলল, তাহলে কি করবি?
গাড়ি তখন দোরগোড়ায় এসে পড়েছিল। কিরীটী নামতে নামতে বলল, ভয় পেলি নাকি সুব্রত? তুই তাহলে বাড়ি ফিরে যা!
সুব্রত লজ্জিত হয়ে চুপ করে রইল।
০৩. দিনচারেক পরের কথা
দিনচারেক পরের কথা। রাত তখন প্রায় নটা কি সাড়ে-নটা। জীবনবাবুর বসবার ঘরে কিরীটী
সুব্রত ও রাজু গল্প করছিল, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল—ক্রিং ক্রিং..
জীবনবাবু উঠে গিয়ে রিসিভারটা কানের কাছে তুলে ধরলেন, হ্যালো!…কে, কিরীটী রায়? ..ডেকে দেবো?…ধরুন।….
রিসিভারটা কাত করে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে জীবনবাবু বললেন, ওহে কিরীটী, পুলিস-ইনসপেক্টর মিঃ রামিয়া তোমায় ফোনে ডাকছেন। কিরীটী তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ফোন ধরল।
মিনিট পনেরো ধরে ফোনে কি-সব কথাবার্তা বলে কিরীটী ফোন রেখে রাজুর সামনে এসে দাঁড়াল।
আমি একবার বাইরে বেরুব জীবন।
ব্যাপার কি বল তো? এত রাত্রে আবার কোথায় যাবে?
কিরীটী বলল, মিঃ রামিয়ার ওখানে।
তারপর রাজুর দিকে ফিরে বলল, সুব্রত থাক, তুই চল আমার সঙ্গে।… কথাটা বলে ওপরে নিজের ঘরে কাপড় বদলাতে চলে গেল কিরীটী।
একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল। গাড়িতে চলতে চলতে একসময় কিরীটী বললে, মিঃ সুন্দর দাস এখানকার একজন মস্তবড় মার্চেন্ট। তাকে তার অফিস-ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং তার ঘরের সেক্রেটেরিয়েট টেবিলের ওপরে রক্তমুখী ড্রাগন আঁকা একটা খাম পাওয়া গেছে। মিঃ রামিয়া সেখান থেকেই আমাকে একটু আগে ফোন করেছিলেন।
আমরাও কি সুন্দর দাসের ওখানেই যাচ্ছি?
হ্যাঁ।
বড় রাস্তার উপরেই মিঃ সুন্দর দাসের প্রকাণ্ড তিনতলা বাড়ি-মার্বেল রক।
রাতের অন্ধকার তখন চারিদিকে বেশ ঘন হয়ে এসেছে, রাস্তার দুপাশের ইলেকট্রিক বাতি থাকায় চারিদিক বেশ আলোকিত।
মার্বেল রকের সামনেই দুজন পুলিস মোতায়েন ছিল। কিরীটী ও রাজুকে এগিয়ে আসতে দেখে তাদেরই একজন জিজ্ঞেস করে, আপনি কি মিঃ কে. রায়?
কিরীটী মৃদুস্বরে বললে, হ্যাঁ।
আসুন আমার সঙ্গে, ইনসপেক্টর সাহেব ওপরে আছেন। কিরীটী ও রাজু লোকটার পিছু পিছু এগিয়ে যায়। সুন্দর দাসের বাড়িতে অফিস-ঘরটা দোতলায় দক্ষিণ কোণে।
একটা লম্বা টানা বারান্দায় পর পর খান-পাঁচেক ঘর, সর্বশেষের ঘরখানাই সুন্দর দাসের অফিস-ঘর।
অফিস-ঘরের পিছনদিকে, নীচে ছোট একটা গলিপথ, সেই গলির অপর পাশে একটা দোতলা বাড়ি। কিরীটীর নজরে পড়ল।
বাড়িটার দরজায় তালাবন্ধ। জানালা-দরজা সব ভিতর হতে বন্ধ।
দুটো বাড়ির ব্যবধান মাত্র হাত-তিনেক।
পুলিসের পিছু পিছু কিরীটী ও রাজু ঘরে এসে প্রবেশ করল।
মিঃ রামিয়া ঘরের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরকার কাগজপত্রগুলো নাড়াচাড়া করে দেখছিলেন।
গুড ইভনিং মিঃ রামিয়া—
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে মিঃ রামিয়া মুখ তুলে তাকালেন।
গুড ইভনিং, আসুন, এই ঘরের মিঃ সুন্দর দাসের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ঐ সুন্দর দাসের মৃতদেহ!
কিরীটী প্রথমেই একবার নিঃশব্দে চোখ বুলিয়ে ঘরটা দেখে নিল।
অতি আধুনিক কায়দায় ঘরখানি সাজানো-গোছানো। মেঝেতে দামী পুরু কার্পেট বিছানো। দেওয়ালে দামী দামী সব ল্যাণ্ডস্কেপ বিদেশী চিত্রকরদের। সিলিং থেকে ঝোলানো সাদা ডিম্বাকৃতি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলোয় সমস্ত ঘরখানি ঝলমল করছে।
সেক্রেটারিয়েট টেবিলের একপাশে গদি-মোড়া একখানি রিভলভিং চেয়ার; তারই একপাশে সুন্দর দাঁসের মৃতদেহ মেঝেয় কার্পেটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কিরীটী নীচু হয়ে মৃতদেহটা পরীক্ষা করে দেখল। মৃতদেহে ক্ষতের চিহ্নমাত্র নেই। কোনরূপ গুলির দাগ বা ছোরাছুরি দিয়ে কাটা কোন ক্ষত পর্যন্ত নেই।
মিঃ রামিয়া বললেন, কোন ইনজুরি বা কিছুই মৃতদেহে নেই।
কিরীটী কোন জবাব দিল না।
মৃতদেহের পজিশানটা আর একবার ভাল করে দেখে কিরীটী আবার ঘরের চারিদিকে তাকায়। বেশ প্রশস্ত ঘরটা। ঘরের মধ্যে যাতায়াত করবার মাত্র একটিই দরজা। বারান্দার দিকে দুটো জানালা, তাতে কাঁচের শার্সি আটা।