এক নিঃশ্বাসে সুব্রত আগাগোড়া সবটা লেখা পড়ে ফেললে।
কিরীটী বললে, কি মনে হয়?
বেশ একটা যেন মিস্ত্রির গন্ধ পাচ্ছি–
ঠিক। যাবি?
কোথায়?
সিলোনে।
সে কি!
চল্ না-সিলোনও বেড়ানো হবে-রহস্যটা পরিষ্কার করা যায় কিনা তাও চেষ্টা করে দেখা যাবে।
আপত্তি নেই, কিন্তু–
জানি সেখানে গিয়ে সেখানকার পুলিসের বড়কর্তার কাছ থেকে অবিশ্যি একটা পারমিশন নিতে হবে—এখানকার আই. জি.-র একটা রেকমেন্ডেশন থাকলে সেটা হয়ত কষ্টসাধ্য হবে না।
যদি সত্যি যাস তো বল—
বললাম তো যাব।
ঠিক আছে, আজই আই. জি.-র সঙ্গে দেখা করব।
কিরীটী বাক্স থেকে একটা চুরোট নিয়ে ধরিয়ে নিল এবং নিভন্ত দেশলাইয়ের কাঠিটা অ্যাশট্রের উপর ফেলে দিয়ে, চুরোটটা টানতে টানতে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।
দিনপাঁচেক বাদে এক সন্ধ্যারাত্রে ওরা ট্রেনে উঠে বসল। কিরীটী, সুব্রত ও রাজু। রাজুও সঙ্গে চলেছে।
কলম্বোয় হোটেলে উঠবি তো? সুব্রত শুধায়।
না–
তবে?
আছে–লোক আছে।
কে লোক?
জীবন সেনগুপ্ত-ওখানকার একজন বড় অফিসার। তাকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছি গতকালই। বম্বে থেকে যে জাহাজ যায় তাতে চাপলে তিন দিনের দিন সকালে কলম্বে পৌঁছানো যায়।
কলম্বো।
সাগরের কোল ছুঁয়ে একেবারে দাঁড়িয়ে শহরটি। এখানে সমুদ্র ভারী অশান্ত বলে ৪২০০ ফুট লম্বা এক বাঁধ তৈরী করে সমুদ্রের গতি রোধ করা হয়েছিল। ১৮৭৫ খ্রীঃ প্রিন্স অব। ওয়েলস এই বাঁধের প্রথম প্রস্তরটি স্থাপন করেন। ১৮৮৪ খ্রীঃ সেই বাঁধের গাঁথুনি সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব-দক্ষিণ কোণ দিয়ে সমুদ্র থেকে বিপদ আসবার তখনও যথেষ্ট সুযোগ রয়ে গেল এবং সেই কারণেই আবার একটি নতুন বাঁধ তৈরী করা হয়। শেষোক্ত বাঁধটি দৈর্ঘ্যে ৮০০ ফুট ও প্রস্থে ৭০০ ফুট।
কলম্বোয় পৌঁছে ওরা জাহাজ থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি নিল, ভিক্টোরিয়া পার্কের অল্প দূরে কিরীটীর বন্ধু জীবন সেন থাকেন। সরকারী দপ্তরে তিনি বেশ মোটা মাহিনার চাকরি করেন। কিরীটীরা সকলে সেইখানেই গিয়ে উঠল।
রাজু ও সুব্রতর ইচ্ছা হোটেলেই ওঠে, কিন্তু জীবনবাবু প্রবল ভাবে আপত্তি জানালেন–না, না, সে কেমন করে সম্ভব?
অগত্যা রাজু ও সুব্রতকেও জীবনবাবুর ওখানেই উঠতে হল। জীবনবাবুর সাহায্যেই পুলিস কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে কিরীটী তার একটা পারমিশন নিয়ে নিল ঐদিনই সন্ধ্যায়।
পরের দিন ভোরবেলায়ই সুব্রতকে নিয়ে কিরীটী বেরুলো মিঃ চিদাম্বরমের বাড়ির খোঁজে। মিঃ চিদাম্বরম কলম্বোর একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। তার বাড়িটি খুঁজে বের করতে তাদের কিছুমাত্র অসুবিধা হল না।
মিঃ চিদাম্বরমের প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ রামানুজ তাদের পরিচয় পেয়েই মহাসমাদরে অভ্যর্থনা করলেন। কিরীটী তাদের আসবার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে বিস্তৃত ভাবে সব কিছু জানতে চাইল।
মিঃ রামানুজম বললেন, তাহলে আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হয়, আমি একবার পুলিস ইনস্পেক্টর মিঃ রামিয়াকে ফোন করে এখানে আনিয়ে নিচ্ছি। ঘটনা সম্পর্কে যা কিছু তদন্ত হয়েছিল, তিনি তা করেছিলেন। আমার মনে হয়, তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অনুসন্ধান করলে সম্ভবতঃ আপনার কাজের সুবিধাই হবে।
কিরীটী বললে, তাহলে তো খুব ভালই হয়।
মিঃ রামানুজ তখনই ইনস্পেক্টর মিঃ রামিয়াকে ফোন করে জানালেন, কলকাতার বিখ্যাত গোয়েন্দা মিঃ কিরীটী রায় এখানে এসেছেন; তিনি মিঃ চিদাম্বরমের কেসটা সম্পর্কে interested। আপনার সাহায্য তার বিশেষ আবশ্যক। আপনি দয়া করে যদি একবার আসেন, তাহলে বিশেষ খুশী হব।
মিঃ রামিয়া সঙ্গে সঙ্গে রাজী হলেন এবং বললেন, এখুনি আসবেন তিনি।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই ইনস্পেক্টর মিঃ রামিয়ার মোটরবাইক চিদাম্বরমের বাড়ির সামনে। এসে দাঁড়াল। হর্নের আওয়াজ হতেই রামানুজ এগিয়ে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এল। পরস্পর আলাপ-পরিচয় ও আদর-অভ্যর্থনার পর মিঃ রামিয়া বললেন, মিঃ রায়, আমাকে গতরাত্রে কমিশনার আপনার কথা বলেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তো এই কেসটার কোন কুল কিনারাই করতে পারিনি। কাজেই এতে আপনার যদি কোন সাহায্য। পাই, তবে সেটা একটা সৌভাগ্য বলে মনে করব।
কতদূর সফল হব জানি না—তবে চেষ্টা করব। কিরীটী বললে।
আপনার কথায় খুবই খুশী হলুম মিঃ রায়। আমি আপনাকে সর্বান্তঃকরণে সাহায্য করতে প্রস্তুত। তাহলে চলুন আমাদের অফিসেই যাওয়া যাক। কারণ চিদাম্বরমের এই কেসটার যাকিছু তদন্ত করা হয়েছে, তার সবই সেখানে গেলেই আপনাকে দেখাতে পারি।
বাড়িতে কে কে তখন জবানবন্দি দিয়েছিল, কি ভাবে তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন, আর ঐ ব্যাপারে আজ পর্যন্ত পুলিস যা-কিছু জানতে পেরেছে, সব কিছুই পুলিস-অফিসে ফাইলে দেখতে পাবেন।
ফাইলের কাগজপত্র দেখে-শুনে আপনি যদি আর কোন ভাবে তদন্ত করতে চান, তখন তাই করা যাবে।
কিরীটী বললে, চলুন, তাহলে এখনই একবার আপনার সঙ্গে গিয়ে কাগজপত্রগুলো দেখে আসি।
সকলেই উঠে দাঁড়াল। মিঃ রামানুজ বাড়ির মোটরগাড়িখানা তাদের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিলেন।
মিঃ রামিয়ার মোটরবাইক ও মিঃ চিদাম্বরমের গাড়িখানা তাদের নিয়ে হর্ন দিতে দিতে পুলিস অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে গেল।
০২. পুলিস-ফাইল অনুসন্ধান
পুলিস-ফাইল অনুসন্ধান করে দেখা গেল—মিঃ চিদাম্বরমের মাথার ওপর একটা বিপদ যে কয়েকদিন আগে হতেই খাঁড়ার মত ঝুলছিল তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।