পরনে তার আজ একটা ক্ৰীম-কলারের জর্জেট শাড়ি ছিল। মাথার অপর্যাপ্ত কেশ তার অবিন্যস্ত।
মিঃ রামিয়া ডিবরাজের শয়নঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিরীটী কিন্তু কৃষ্ণার সামনে এসে দাঁড়াল, কৃষ্ণা!
কৃষ্ণা মুখ তুলে তাকাল। দুচোখ-ভরা লোনা টলটলে অশ্রু। কান্না-ভেজা গলায় বললে, মিঃ রায়, ড্যাডি–
আমারই বোধ হয় দোষ কৃষ্ণ—
আপনার দোষ! বিস্ময়ে কৃষ্ণা কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ, আমি-আমি যদি আর একটু সাবধান হতাম-কখন ব্যাপারটা ঘটেছে? কখন টের পেলেন?
ড্যাডি বের হয়েছিলেন সন্ধ্যার পর, তাঁরই পার্সোনাল সেক্রেটারী রাজীবলোচনের একটা ফোন পান অফিস থেকে, বেরুবার সময় বলে যান, ফিরতে যদি রাত হয় তো আমি যেন ডিনার সেরে নিই, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
আর কিছু বলেন নি মিঃ ডিবরাজ?
না। তবে অধস্ফুট ভাবে বলেছিলেন যেন আমার মনে হল-বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে, রাজীবটা একটা অপদার্থ!
আর কিছু?
না।
রাজীব কতদিন আপনাদের এখানে আছেন?
নতুন লোক-বৎসরখানেক এসেছেন।
আগে কে ছিল?
কৃষ্ণাপ্পা।
সে কি কাজ ছেড়ে দিয়েছে?
না, বাবা তাকে বোম্বাইয়ের অফিসে পাঠিয়েছিলেন—সে সেখানেই আছে—
মিঃ ডিবরাজ কি আজ বাড়িতেই ছিলেন?
হ্যাঁ, আজ বাড়ি থেকে বের হননি।
কেউ আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?
না।
এমন কোন ঘটনা কি ঐ সময়ের মধ্যে ঘটেছে, যেটা আপনার মনে আছে?
না, তবে—
বলুন?
বিকেলের ডাকে ড্যাডির নামে একটা ছোট পার্সেল এসেছিল।
পার্সেল? কিসের পার্সেল?
ড্যাডির টেবিল-ক্লকটা হঠাৎ পড়ে গিয়ে টেবিল থেকে দিন-পনের আগে ভেঙে যায়, তাই ড্যাডি লণ্ডনের একটা ওয়া কোম্পানীতে চিঠি দিয়েছিলেন—ঠিক ঐরকম একটি টেবিল-ক্লক পাঠাবার জন্য—বোধ হয় সেটাই–
পার্সেলটা আপনার ড্যাডিকে খুলতে দেখেছিলেন?
না।
বাড়িতে আপনাদের কজন চাকর-বেয়ারা?
দুজন মাদ্ৰাজী ভৃত্য-কৃষ্ণান আর রামনাথন, আয়া কুডি, কুক আব্দুল, ড্রাইভার দেলোয়ার সিং আর দুজন পাঠান দরোয়ান-হামিদ খান আর হবিবুল্লা খান।
এরা সবাই বিশ্বাসী?
সবাই বিশ্বাসী।
কতদিন কাজ করছে এ বাড়িতে ওরা?
অনেক বছর।
আপনার ড্যাডির নতুন সেক্রেটারী রাজীবলোচনকে আপনার কি রকম মনে হয়?
ড্যাডি, তো ওর খুব প্রশংসা করত, বলত লোকটা যেমন স্মার্ট তেমনি কর্মঠ, তেমনি পরিশ্রমী ও বিশ্বাসী।
কত বয়েস হবে তার? তাকে তো দেখিনি আমি!
না, আপনারা যেদিন এসেছিলেন—রাজীব তখন বাংলোতে ছিল না।
এই বাংলোতেই কি সে থাকে?
যা, পারলারের পাশের ঘরটায়।
১০. কিরীটী অতঃপর শুধাল
কিরীটী অতঃপর শুধাল, ব্যাপারটা কখন আপনি টের পেয়েছেন? আজ রাত্রে?
ড্যাডির শোবার ঘরের পাশেই আমার বেডরুম, কৃষ্ণা বলতে লাগল, রাত দশটা পর্যন্ত ড্যাডি এল না দেখে আমি তার অফিসে ফোন করেছিলাম।
ড্যাডি কি বললেন?
ড্যাডি অফিসে ছিল না—
ছিল না?
না। রাজীব ফোন ধরেছিল—সে বললে, ড্যাডি নাকি বিশেষ কি একটা মালের ডেসপ্যাচের ব্যাপারে পোর্টে গিয়েছেন-কাল সকালেই জাহাজ ছাড়বে, সেখান থেকেই বাসায় যাবেন বলে গিয়েছেন। একটু রাত হবে, আমি যেন না অপেক্ষা করি আর তার জন্য আমাকে খেয়ে শুয়ে পড়তে বলেছেন।
হুঁ। রাজীব কোথায়?
এখনো তত ফেরেনি।
ঠিক জানেন?
হ্যাঁ।
আপনার ড্যাডি কখন ফিরেছেন জানেন?
না, আমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তবে কৃষ্ণান বললে, রাত এগারটায় নাকি সে ড্যাডিকে ফিরে তার শোবার ঘরে ঢুকতে দেখেছে–
তারপর? জানলেন কখন ব্যাপারটা?
রাত তখন সোয়া এগারোটা হবে, কুট্টি এসে আমাকে ঘুম থেকে তোলেসে ড্যাডিকে ওঠাতে গিয়েছিল—ড্যাডি ডিনার করবে কিনা জানতে। কিন্তু গিয়ে দেখে ভিতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ। অথচ ঘরে আলো জ্বলছিল, সে তখন দরজায় নক্ করে, কিন্তু কোন সাড়া পায়। না। ডাকে সাহেবসাহেব বলে, তবু কোন সাড়া নেই। ঠিক সেই সময় ঘরের ভিতরে দড়াম করে কিছু ভারী জিনিস পড়ার শব্দ শুনতে পায়। ব্যাপারটা কি বুঝতে না পেরে কুটি তখন কৃষ্ণানকে ডাকে।
তারপর দুজনে মিলে দরজা ধাক্কাধাক্কি করে সাড়া না পেয়ে এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। আমি গিয়েও ডাকাডাকি করি, দরজায় ধাক্কা দিই, সাড়া পাই না। তখন ভিতরের জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি দেখতে পেলাম–
কি-কি দেখতে পেলেন?
ড্যাডি উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে আছেন, সামনেই টেবিলের ওপরে সেই পার্সেলের ডালাটা খোলা—আর
আর?
দেখলাম সেই পার্সেল থেকে একটা কি ধোঁয়ার মত বেরুচ্ছে। এবং একটা পাতলা সবুজবর্ণের কুয়াশার মত কি যেন ভাসতে ভাসতে ঘরের মধ্যে ক্রমশঃ একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে।
যা, হলুদ শয়তানের গ্যাসীয় মৃত্যুদূত-তীব্র বিষাক্ত কোন গ্যাসজাতীয় পদার্থ খুব সম্ভব ঐ পার্সেলের মধ্যেই ছিল, যেটা পার্সেল খুলতেই বের হয়ে মৃত্যুছোবল হেনেছে।
কিরীটী ততক্ষণে ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছে-সে আর ওখানে দাঁড়াল না। ডিবরাজের ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।
ছিমছাম সাজানো বেডরুমটি। আকারে বেশ বড়ই হবে। একটা সিঙ্গল খাটে শয্যা বিছানো–শয্যা দেখে বোঝা যায় সেটা কেউ তখনো স্পর্শও করেনি, এক পাশে টেবিলের উপরে একটা ভালা-খোলা পার্সেল।
মিঃ রামিয়া ঘরের চারিদিক পরীক্ষা করে দেখছেন।
কিরীটীকে ঢুকতে দেখে বললেন, funny! ভিতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল-কৃষ্ণান বলছে বাইরের বন্ধু জানলার সাসী ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে সে দরজা খুলেছে, বাথরুমের দরজাটাও ভিতর থেকে বন্ধ ছিল—তবে আততায়ী ঢুকল কি করে বলুন তো মিঃ রায়?