দেড়বিঘৎ পরিমাণ, লোহার শলা নয়—একটা তীর, অগ্রভাগটা সামান্য চেপ্টা, কিন্তু ছুঁচলো।
কিরীটী বললে, মনে হচ্ছে বিষের তীর এটা—
বিষের তীর! ডিবরাজ শুধালেন।
হ্যাঁ, খুব সম্ভব তীরের ফলায় কোন তীব্র মারাত্মক বিষ মাখানো ছিল, যে বিষের ক্রিয়াতেই আপনার সিজারের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় মৃত্যু হয়েছে। চলুন, আর এখানে থেকে কি হবে, ভিতরে চলুন।
মিঃ ডিবরাজকে নিয়ে কিরীটী পশ্চিম দিককার বারান্দায় ফিরে এল।
মিঃ রামিয়া আর কৃষ্ণা দুজনেই বারান্দায় উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
কি হয়েচে ড্যাডি? কৃষ্ণা শুধায়।
কৃষ্ণা, সিজার মারা গেছে! কান্না-ধরা-গলায় মিঃ ডিবরাজ বললেন।
মারা গেছে?
হ্যাঁ।
কী করে?
কিরীটী হাতের তীরটা তুলে ধরে বললে, এই বিষাক্ত তীরে।
কোথা থেকে এল এটা?
সম্ভবত রক্তমুখী ড্রাগনের কোন অনুচরেরই কাজ এটা। কিরীটী বললে।
রক্তমুখী ড্রাগন!
হ্যাঁ কৃষ্ণা, মিঃ ডিবরাজ ভাঙা গলায় বললেন, তোমাকে জানাইনি, রক্তমুখী ড্রাগন আমাকে চিঠি দিয়েছে
কবে? কখন?
দিনকয়েক আগে।
আহারে আর কারুরই রুচি ছিল না।
সবাই খাদ্যবস্তু নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল যেন।
সিজারের আকস্মিক মৃত্যুর বিষণ্ণতা যেন সকলের মনকেই আচ্ছন্ন করে ফেলছিল।
কিরীটী একসময়ে বললে, সিজার থাকলে তাদের সুবিধা হবে না, তাই তারা সিজারকে হত্যা করেছে মিঃ ডিবরাজ!
আর আমার সাহস হচ্ছে না মিঃ রায়। মিঃ ডিবরাজ বললেন।
মিঃ রামিয়া বললেন, ভয় পাবেন না মিঃ ডিবরাজ-আমাদের প্রহরা কাল থেকে আরো কড়া হবে।
কিরীটী কোন কথা বলে না, চুপ করে কি যেন ভাবে।
কৃষ্ণাও চুপচাপ একেবারে।
অনেক রাত্রে ওরা বিদায় নিল।
০৯. রাত তখন প্রায় এগারোটা হবে
পরের দিন রাত্রে।
রাত তখন প্রায় এগারোটা হবে।
ফোনের একটানা ক্রিং ক্রিং শব্দে সর্বপ্রথম কিরীটীর ঘুমটা ভেঙে যায়।
ব্যাপার কি? এত রাত্রে কার ফোন?
পাশের ঘরেই ছিলেন জীবনবাবু-তারও ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তিনি রিসিভারটা তুলে নিলেন, হ্যালো, কে-মিঃ রামিয়া! কিরীটীকে ডেকে দেব? জরুরী? হ্যাঁ হ্যাঁ, এখুনি দিচ্ছি।
কিরীটী তার নামটা পাসের ঘরে কানে যেতেই শয্যা থেকে উঠে মধ্যবর্তী দরজাটা দিয়ে জীবনবাবুর শয়নকক্ষে এসে প্রবেশ করল, কে ফোন করছে জীবন?
তোমার ফোন। ইনসপেক্টার মিঃ রামিয়া—
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরল, কে মিঃ রামিয়া, আমি কিরীটী। কি—কি বললেন?
ওপাশ থেকে তখন মিঃ রামিয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলে চলেছেন, এইমাত্র ডিবরাজের সামনে যে প্রহরীরা প্রহরায় ছিল তারা আমাকে ফোন করেছে-তিনি খুন হয়েছেন
কখন? কি করে হল?
জানি না—আমি সেখানে যাচ্ছি-আপনি কি আসবেন?
নিশ্চয়ই যাব।
তাহলে প্রস্তুত থাকুন, যাবার পথে আমি তুলে নিয়ে যাব।
কিরীটী চটপট প্রস্তুত হয়ে নেয়।
সুব্রত ও রাজুর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। সব শুনে তারাও বললে যাব। কিরীটী বললে, না, সকলেই আমরা যাব না। তোরা থা—আমি একাই যাচ্ছি। প্রয়োজন হলে তোদর জানাব।
সুব্রত বললে, কিন্তু কিরীটী–
ডাঃ ওয়াং-সেই হলুদ শয়তানের যতটুকু পরিচয় পেয়েছি, তার খরদৃষ্টি নিশ্চয়ই সর্বক্ষণ আমাদের ওপরে আছে। কেবল ডিবরাজকেই হয়ত হত্যা করেনি শয়তানটা, আমার জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে কিনা ইতিমধ্যে সেখানে একটা কে জানে! যদি একটা কিছু ঘটেই দুর্ঘটনা–তোরা বাইরে থাকলে হয়ত কাজে লাগতে পারবি-পুলিস-চীফ মিঃ বন্দরনায়ককে সঙ্গে সঙ্গে জানাবি ব্যাপারটা। নিশ্চয়ই তিনি সবরকম সাহায্যই করবেন।
সুব্রত আর রাজু আপত্তি করল না।
কিরীটী পকেটে একটা শক্তিশালী পেনসিল টর্চ, একটা পাকানো কর্ড, একটা ছুরি ও অ্যানিয়া লোশনের একটা ছোট শিশি নিয়ে নিল।
বাইরে ঐ সময় মিঃ রামিয়ার গাড়ির হর্ন শোনা গেল।
চললাম—অ্যালার্ট থাকিস! কিরীটী বের হয়ে গেল।
ঘুমন্ত জনহীনপ্রায় রাস্তা ধরে ভিক্টোরিয়া পার্কটার দিকে মিঃ রামিয়ার গাড়ি পঞ্চাশ মাইল স্পীডে ছুটে চলেছিল।
কিরীটী শুধায়, আপনার প্রহরী আর কোন সংবাদ দিয়েছে?
না।
কিরীটী বললে, দোষটা আমারই মিঃ রামিয়া, আমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তার আস্ফালন যে নিষ্ফল নয়, দুর্বলের বহ্রারম্ভ নয় জানা উচিত ছিল আমার—তাহলে হয়ত আজকের দুর্ঘটনা ঘটত না।
কিন্তু এ যে সত্যিই এক ভয়াবহ বিভীষিকার সৃষ্টি করল হলুদ শয়তানটা মিঃ রায়! মিঃ রামিয়া বললেন।
হ্যাঁ, তা করেছে। তারপর একটু থেমে বললে, তবে আজকের খেলাই তার শেষ খেলা!
বাংলোর মধ্যে গাড়িটা প্রবেশ করতেই পোর্টিকোর সামনে দেখা গেল দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে, তাদেরই একজন ফোন করেছিল মিঃ রামিয়াকে।
লাশ কোথায়? মিঃ রামিয়া জিজ্ঞাসা করলেন।
মিঃ ডিবরাজ তার শয়নঘরেই নিহত হয়েছেন।
কে ফোন করেছিল আমায়?
প্রথম প্রহরী বললে, আমিই।
আর চারজন প্রহরী কোথায়?
দুজন এখনো বাইরে-আমরা তিনজন ভিতরে—
কিরীটী ঐসময় প্রশ্ন করলে, তোমাদের দুজনকেই তো দেখছি, আর একজন কই?
সে ভিতরে মৃতদেহ পাহারা দিচ্ছে।
ওরা ভিতরের দিকে অগ্রসর হল।
পার্লার পার হয়ে অন্দরে পা দিতেই একটা মৃদু কান্নার আওয়াজ কিরীটীর কানে এল। কে যেন গুমরে গুমড়ে কাঁদছে।
কৃষ্ণা কি? কিরীটীর মনে হয়, কৃষ্ণাই হয়ত কাঁদছে। পুওর গার্ল। হ্যাঁ, দেখা গেল আর একটু এগুতেই, ঘরের সামনে বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুলে ফুলে কাদছে কৃষ্ণা।