- বইয়ের নামঃ হলুদ শয়তান
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. মিঃ চিদাম্বরম অদৃশ্য
মিঃ চিদাম্বরম তার শয়নকক্ষ থেকে রহস্যজনক ভাবে একরাত্রে অদৃশ্য হবার পর খানাতল্লাশী করতে গিয়ে সিংহল পুলিস তার ডাইরীটা পেয়েছিল। সেই ডাইরীতেই কথাগুলো লেখা ছিল শেষ পৃষ্ঠায়।
স্পষ্ট একটা খসখস্ আওয়াজ। ঘরের মধ্যে কেউ এসেছে নিশ্চয়ই! ঘরের আবছা অন্ধকারে তারই সাবধানী পায়ের মৃদু ক্ষীণ শব্দ। কী এক ভৌতিক বিভীষিকায় মন মর্মায়িত হয়ে ওঠে। কে?
ঘুম আর হল না। উঠে বসলাম। অন্ধকারে রেডিয়াম-দেওয়া ঘড়ির ডায়ালটা চিকচিক করে জোনাকির আলোর মত জ্বলে।
ঘড়িতে রাত্রি দুটো। আজ তিন রাত্রি ধরে প্রত্যহই ঠিক এমন সময় আমার ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে। শুনতে পাই একটা অস্পষ্ট লঘু পায়ে চলার শব্দ যেন ঘরের মধ্যে অন্ধকারে চলে বেড়ায়। ক্ষীণ স্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
আমার গায়ের ভিতরটা সিরসির করে। ভয়ের একটা তরল স্রোত যেন রক্তের নলীতেনলীতে ছড়িয়ে যায়। সমস্ত দেহটাকে অসাড় ও পঙ্গু করে দেয়।
আজ নিয়ে পর পর তিন রাত্রি ঐ শব্দ শুনে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি। সুইচ টিপে আলোটা জ্বেলেছি, তার পর শয্যার উপর বসে থেকেছি। আর আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম, হয়ত আমার মনের ভুলও হতে পারে, মশারীটা যেন ক্রমশ নীচের দিকে ঝুলে পড়ছিল। আর ঘুম আসেনি-আজো আমার না জানি—
খালি ঘর। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। দরজার হাতল ধরে টেনে দেখেছি প্রতি রাত্রেই, দরজা পূর্বের মতই বন্ধ।
জানলার নেটের পর্দা দুপাশে টেনে সরিয়ে দেখেছি, কোথাও কিছু নেই—
তবে কি সবটাই আগাগোড়া একটা দুঃস্বপ্ন!
পুলিসের রিপোর্ট থেকে মিঃ চিদাম্বরমের সম্পর্কে যা জানা যায়, মিঃ চিদাম্বরমের বয়স এমন বেশী কিছু নয়, চল্লিশের কোঠা সবে ছাড়িয়েছিলেন। সংসারে আপনার বলতে একটি মাত্র ভাইপো-রূপ। বয়স তার তেইশ কি চব্বিশ। ভারতের দক্ষিণ দেশের লোক, ভাষা তামিল। গত পনের বৎসর ধরে মুক্তা ও রবারের ব্যবসায়ে চিদাম্বরম আজ প্রায় কোটিপতি। সিংহলে মুক্তা ছাড়াও মস্তবড় রবারের কারবার ছিল। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে মুক্তা ও রবার। চালান যেত তাঁর।
স্থানীয় পুলিসের রিপোর্ট থেকে জানা যায় আবার-চিদাম্বরমের শয়ন-ঘরে শয্যাই কেবল খালি ছিল না তা নয়-মশারীটাও ছিল না। আর শয্যার উপর চাদরটা এলোমেলো হয়ে ছিল আর সারা ঘরের বাতাসে যেন একটা কেমন মিষ্টি অথচ উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে ছিল অনেকটা ক্লোরোফরমের মত।
জংলী চায়ের কাপটা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। লেপের ভিতর হতে মাথাটা একটু বের করে কিরীটী বললে, জংলী, আজকের খবরের কাগজটা দিয়ে যাস।
খবরের কাগজ তো অনেকক্ষণ রেখে গেছি বাবু; ঐ যে টি-পয়ের ওপর।
হাত বাড়িয়ে কিরীটী সেদিনকার সংবাদপত্রটা তুলে নিল।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। সংবাদপত্রের ভাঁজটা খুলতে খুলতে কিরীটী বললে, সুব্রত আসছে, যা, আর এক কাপ চা নিয়ে আয়।
সুব্রত ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললে, উঃ! কী শীত রে বাবা! জমাট বেঁধে গেলাম!
কিরীটী খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললে, গরম গরম চা খেয়ে আবার গলে যাও! তারপর কি হে, সক্কালবেলাতেই!
শীতের বাজারটা একেবারে মন্দা চলছে! এমনি করে আর বেশী দিন বসে থাকলে গেঁটে বাত ধরবে দেখছি!
কিরীটীর দিক থেকে বিশেষ কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। জংলী আর এক কাপ চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।
সুব্রত চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, দেখছি তোর রহস্যভেদের ছোঁয়াচ বোধ হয় আমারও লেগেছে, দিনরাত কেবল রহস্যেরই স্বপ্ন দেখছি। রাতের অন্ধকারে জেগে জেগে কান পেতে অশরীরীর পায়ের শব্দ শোনবার জন্য চেষ্টা করি। রাজু তো যেখানে যত ডিটেকটিভ বই আছে সব কিনে এনে একটার পর একটা শেষ করছে।
কিরীটীর কোন সাড়া-শব্দ নেই। চায়ের কাপটা নিঃশেষ করে টি-পয়টার উপর রাখতে রাখতে সুব্রত বললে, কি হে, ব্যাপার কি? স্পিকটি নট যে! নতুন খবর আছে নাকি কিছু সংবাদপত্রের মধ্যে? ওদিকে চা যে ঠাণ্ডা হতে চলল!
তথাপি কিরীটীর দিক থেকে কোন জবাব এল না। চায়ের কাপের দিকে হাত বাড়াল। তারপর এক সময় খবরের কাগজটা পাশে রেখে চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিতে দিতে বললে, আবার ড্রাগন! এবারে কালো নয়, রক্তমুখী!
ড্রাগন! কোথায় ড্রাগন?
কিরীটী আবার বললে, ড্রাগন!
ড্রাগন-ড্রাগনই তো বলছিস তখন থেকে, কিন্তু কোথায় ড্রাগন?
ড্রাগন! রক্তমুখী ড্রাগন! বিশ্বাস হচ্ছে না? এই কাগজটা পড়ে দেখ—
কিরীটী খবরের কাগজটার একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে বললে, পড়।
সুব্রত কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গাটার উপর ঝুঁকে পড়ল।
কলম্বোয় রক্তমুখী ড্রাগনের দ্বিতীয় শিকার!!
মুক্তা ও রবার ব্যবসায়ী লক্ষপতি ধনী
মিঃ চিদাম্বরম অদৃশ্য!
গত শনিবার কলম্বোর প্রসিদ্ধ মুক্তা ও রবার ব্যবসায়ী ক্রোড়পতি চিদাম্বরম তার শয়নকক্ষ হতে অদৃশ্য হয়েছেন। তার শয়নঘরে শয্যার উপর একখানি অতি সাধারণ সাদা রংয়ের খাম পাওয়া গেছে। তাতে এক ড্রাগনের প্রতিমূর্তি আঁকা। মূর্তির দেহটা কালো রংয়ের ও মুখটা ঘোর রক্তবর্ণের। মাসখানেক পূর্বে (পাঠক বর্গের মনে থাকতে পারে) বম্বের একজন ধনী মৎস্যব্যবসায়ী তার শয়নকক্ষ হতে একই ভাবে অদৃশ্য হন। তারও শূন্য শয্যার উপর অবিকল ঐরূপ একটি রক্তমুখী ড্রাগনের মূর্তি-আঁকা খাম পাওয়া গিয়েছিল। সমগ্র কলম্বোবাসী, বিশেষতঃ ধনী ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে যিয়মাণ হয়ে পড়েছে। সবাই ভাবছে, না জানি এবার কার পালা! পুলিশ তদন্ত করেও আজ পর্যন্ত কিছু করে উঠতে পারেনি। আমরা জনসাধারণের দিক হতে পুলিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের এই বিষয়ে ভালভাবে তদন্ত করে দেখবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। আশা করি তারা এদিকে একটু নজর দেবেন।