আপনি? কিরীটী প্রশ্ন করে রমণীমোহনের দিকে তাকিয়ে।
আমি এ বাড়ির মালিক–রমণীমোহন কুণ্ডু।
ওঃ, ইনি সামন্ত মশায়ের বন্ধু। রাধারমণ বললেন।
শুনলাম সামন্ত মশাইয়ের নাকি কি হয়েছে?
রাধারমণ পাল চুপ করে ছিলেন। কিরীটীই প্রশ্নটার জবাব দিল, মারা গেছেন। মনে হচ্ছে কোন তীব্র বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটেছে।
সর্বনাশ! পয়জনিং?
হ্যাঁ।
এখন উপায়?
থানায় একটা সংবাদ পাঠাতে হবে।
হ্যাঁ, এখুনি পাঠাচ্ছি। হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেলেন রমণীমোহন কুণ্ডু।
কিরীটী আবার পাল মশাইয়ের দিকে তাকাল। ভদ্রলোকের মুখটা যেন এর মধ্যেই কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। মধ্যে মধ্যে পুরু ঠোঁটটা জিভ দিয়ে চেটে ভিজিয়ে নিচ্ছেন।
পাল মশাই!
আজ্ঞে?
আপনাদের দলের সর্বশেষ আজ রাত্রে কার সঙ্গে সামন্ত মশাইয়ের দেখা হয়েছিল, সেকথা জানতে পারলে হত!
পাল মশাই একটা ঢোঁক গিলে বললেন, আমার সঙ্গে—মানে পালা শুরু হবার পর থেকে আমি এখানে আসিইনি।
তাহলে আপনার সঙ্গে পালা শুরু হবার পর আর সামন্ত মশাইয়ের দেখা হয়নি?
না।
হুঁ। আপনারা? কিরীটী পর্যায়ক্রমে সকলের দিকে তাকাল।
তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পর্যায়ক্রমে একে একে সকলের মুখের উপরই ঘুরে এলো।
চিত্রার্পিতের মত যেন সব দাঁড়িয়ে। কারও মুখে কথা নেই।
কেউ আপনাদের মধ্যে আজ পালা শুরু হবার পর এখানে আসেননি? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
রোগা মত এক ব্যক্তি এগিয়ে এল। বয়স বত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে বলে মনে হয়।
কিরীটী পুনরায় তাকে প্রশ্ন করে, আপনি এসেছিলেন?
না। তবে তৃতীয় অঙ্ক শুরু হবার পর একবার আমি এখানে শ্যামলকুমারকে আসতে দেখেছি। আর তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি-সামন্ত মশাই তখন আসরে, সুভদ্রা দেবীকে এই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে দেখেছিলাম।
কিরীটী বক্তার মুখের দিকে তাকাল।
রোগা পাকানো চেহারা। চোখের কোল বসা। ভাঙা গাল। নাকটা খাঁড়ার মত উঁচু। মাথায় একমাথা ঢেউ-খেলানো বাবরি চুল। মুখে প্রসাধনের চিহ্ন। পরনে তখনও অভিনয়ের পোশাক।
কিরীটীর মনে পড়ল, লোকটি ভাল অভিনেতা। বর্তমান নাটকে ভিলেনের পার্ট করছিল। পালায় নায়িকার অন্যতম প্রেমিক। হতাশায় সে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিল।
কি নাম আপনার?
আজ্ঞে সুজিতকুমার মিত্র।
এই দলে আপনি কতদিন আছেন?
কতদিন—মানে, ধরুন গে বছর ছয়েক তো হবেই। আগে তো আমিই এ দলে হিরোর রোল করতাম। রোগে রোগে চেহারাটা ভেঙে যাওয়ায় পাল মশাই আর আমাকে হিরোর পার্ট দেন না, ভিলেনের পার্ট করি।
হুঁ। তা আপনি দেখেছেন শ্যামলকুমার আর সুভদ্রা দেবীকে এই ঘরে আসতে?
আজ্ঞে বললাম তো এইমাত্র, শ্যামলকুমারকে আমি ঢুকতে দেখেছি, কিন্তু বের হয়ে যেতে দেখিনি। আর, সুভদ্রা দেবীকে বেরোতে দেখেছি কিন্তু ঢুকতে দেখিনি।
শ্যামলকুমার ভিড়ের মধ্যে এক পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিরীটী শ্যামলকুমারের মুখের দিকে তাকাল।
শ্যামলবাবু, তৃতীয় অঙ্কের গোড়ায়—কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনি এসেছিলেন এ ঘরে?
হ্যাঁ। সামন্ত মশাই ডেকে পাঠিয়েছিলেন—একটা চিরকুট দিয়ে।
চিরকুট!
হ্যাঁ।
বলতে বলতে পকেটে হাত চালিয়ে ছোট একটুকরো কাগজ বের করল শ্যামলকুমার।
দেখি—কিরীটী চিরকুটটা হাতে নিল।
ছোট একটুকরো প্রোগ্রাম-ছেঁড়া কাগজ—তাতে পেনসিলে লেখা,শ্যামল, একবার আমার ঘরে এস।
নীচে কোন নামসই নেই।
এতে তো দেখছি কারুর নামসই নেই। তা এটা যে সামন্তরই পাঠানো, বুঝলেন কি করে?
আজ্ঞে দলের চাকর ভোলা আমাকে চিরকুটটা দেয়।
ভোলা? কোথায় সে?
ভোলা ভিড়ের মধ্যে সবার আড়ালে পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল, এগিয়ে এল।
কালো বেঁটে নাদুস-নুদুস চেহারা। পরনে একটা ধুতি ও গায়ে গেঞ্জি। বয়স বছর ত্রিশেক হবে। চোখের দৃষ্টিতে বেশ যেন একটা সতর্কতা।
তোমার নাম ভোলা? কিরীটী শুধাল।
আজ্ঞে।
বাবুকে তুমি ঐ চিরকুটটা দিয়েছিলে?
আজ্ঞে।
সামন্ত মশাই তোমাকে দিতে দিয়েছিলেন?
আজ্ঞে নিজের হাতে দেননি—
তবে! চিরকুটটা তুমি কোথায় পেলে?
রাধারাণী দিদিমণি চিরকুটটা আমায় দিয়েছিলেন।
তিনি কে?
এবার একটি বছর ত্রিশ বয়সের রমণী এগিয়ে এল।
আমার নাম রাধারাণী।
আপনি দিয়েছিলেন ওকে চিরকুটটা? কিরীটী প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ।
আপনাকে সামন্ত মশাই দিয়েছিলেন?
না। দ্বিতীয় অঙ্কের শেষের দিকে আমি যখন আসর থেকে সাজঘরের দিকে যাচ্ছি, কে যেন আমাকে চিরকুটটা দিয়ে বললে, এটা ভোলাকে দিয়ে বলবেন শ্যামলবাবুকে দিয়ে যেন বলে সামন্ত মশাই তাঁকে এ ঘরে ডেকেছেন।
কে সে?
প্যাসেজে ভাল আলো ছিল না আর আমারও তাড়াতাড়ি ছিল, ভাল করে চেয়ে দেখিনি, নজরও দিইনি।
তার গলাও চেনেননি?
না। ঠিক তাড়াতাড়িতে—
হুঁ, তারপর?
ভোলা আমাদের সাজঘরের বাইরেই ছিল—তাকে চিরকুটটা দিয়ে বলি শ্যামলবাবুকে দিয়ে আসতে, সামন্ত মশাই দিয়েছেন। শ্যামলবাবুর সাজঘরটা আমাদের পাশের ঘরেই।
ঐ সময় হঠাৎ দণ্ডায়মান অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের মধ্য থেকে মধ্যবয়সী কালো গাঁট্টাগোট্টা এক ভদ্রলোক, যিনি সুভদ্রা হরণ পালায় সুভদ্রার মামার পার্ট করেছিলেন—তিনি এগিয়ে এসে বেশ যেন একটু রুক্ষ কর্কশ গলাতেই বললেন, কিন্তু মশাই, আপনার পরিচয় জানতে পারি কি? আপনি কে? পুলিসের মত আমাদের এই জেরা করছেন কেন? আপনি কে? আপনি তো বাইরের লোক। পুলিসকে আসতে দিন, তাদের কাজ তারাই করবে।