আমারও।
আমি ঠিক করেছি—
কি ঠিক করেছ?
আজ রাত্রেই আমরা পালাব।
আমি প্রস্তুত।
ইচ্ছে ছিল না আদৌ আমার এভাবে তোমাকে অপহরণ করে চোরের মত রাতের অন্ধকারে সরে পড়বার, কিন্তু–
কিন্তু কি?
সামনে দিয়ে গেলে ঐ বৃদ্ধ মনে নিদারুণ আঘাত পাবে। সুখের ঘর বাঁধতে চলেছি, কারও মনে কোন দুঃখ দেব না। ভাল করে শেষবারের মত ভেবে দেখ, তোমার মনে কোন চিন্তা বা সংকোচ নেই তো?
এতটুকুও না। ওর কুৎসিত দৃষ্টি আমাকে যেন লোভীর মত সর্বক্ষণ লেহন করছে। অথচ ও আমার পালিত বাপ। মুক্তি চাই আমি—মুক্তি চাই।
চল।
দুজনে হাত ধরাধরি করে আসর থেকে বের হয়ে যাবার উপক্রম করবে, আর ঠিক বেরুবার আগেই বাড়ির ভৃত্য এসে বলবে, দিদিমণি, শিগ্রী চলুন, বাবু কত্তাবাবু বোধ হয় মারা গেছেন।
কিন্তু ভৃত্য আর আসে না।
ভৃত্যও আর আসে না, ওরাও নাটকের সংলাপগুলো বলতে পারে না। ওরা ঘন ঘন ভৃত্য আসার প্রবেশপথের দিকে তাকাতে থাকে। নিজেদের মধ্যেই অস্ফুট কণ্ঠে বলাবলি করে ওরা। কিরীটী সামনে বসেই শুনতে পায়।
কি ব্যাপার, চাকর আসছে না কেন?
দু মিনিট, চার মিনিট, পাঁচ মিনিট কেটে গেল। অথচ ভৃত্য আসছে না আসরে।
সুভদ্রা আর শ্যামলকুমার পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
দুজনেরই চোখে সপ্রশ্ন দৃষ্টি।
দর্শকরা প্রথমটায় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি, কিন্তু প্রায় যখন আট দশ মিনিট ঐ অবস্থায় কেটে যাবার উপক্রম হল তখন তাদের মধ্যেও একটা ফিসফিসানি, চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।
লে বাবা, এরা দুটি সঙের মত দাঁড়িয়ে রইল কেন? কে একজন বললে।
আর একজন টিপ্পনী কাটল, কি বাবা, ভাগব বলে এখনও দাঁড়িয়ে কেন? কেটে পড় বাপু, দুটিতে তো বেশ জোট মানিয়েছে!
ওরাও বোধ হয়—সুভদ্রা আর শ্যামলকুমার কেমন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। বৃদ্ধের ভৃত্যের আবির্ভাবের পর যে সংলাপ তাও বলতে পারছে না, এদিকে ভৃত্যেরও দেখা নেই।
অবশেষে বুদ্ধি খাটিয়ে শ্যামলকুমার বললে, চল সুভদ্রা, আর দেরি করা উচিত নয়।
হ্যাঁ, চল।
ওদের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে সারা প্যান্ডেল যেন এক অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল।
কিরীটী নাটকের শেষটুকু জানত। হরিদাসের মুখেই শুনেছিল।
কিরীটীও ঠিক বুঝতে পারে না, ব্যাপারটা ঠিক কি ঘটল!
ভৃত্যের আসরে আবির্ভাব হল না কেন?
হঠাৎ কি একটা কথা মনে হওয়ায় তাড়াতাড়ি কিরীটী উঠে পড়ল এবং দ্রুতপদে সাজঘরের দিকে পা বাড়াল।
দর্শকরাও ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না।
তারা তখন হাসি থামিয়ে রীতিমত চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, এটা কি হল? এ কেমন পালা রে বাবা?
০৫. হরিদাস সামন্তর সাজঘরে
হরিদাস সামন্তর সাজঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল কিরীটী।
সেখানে তখন যাত্রাদলের আট-দশজন জমায়েত হয়েছে, পাল মশাইও উপস্থিত। শ্যামলকুমার ও সুভদ্রাও পৌঁছে গিয়েছে সে ঘরে।
একটা চাপা গুঞ্জন ঘরের মধ্যে যেন বোবা একটা আতঙ্কের মত থমথম করছে। ভিড় ঠেলে সামনের দিকে দুপা এগুতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল কিরীটীর।
সামন্ত মশাই চেয়ারের উপর বসে আছেন। পরনে তাঁর অভিনয়েরই সাজপোশাক। মাথাটা বুকের উপর ঝুলে পড়েছে ঘাড়টা ভেঙে যেন।
দুটো হাত অসহায় ভাবে চেয়ারের দুপাশে ঝুলছে। পায়ের সামনে একটা কাচের গ্লাস।
কি ব্যাপার? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
বুঝতে পারছি না রায় মশাই, অধিকারী রাধারমণ পাল বললেন, ঘরে ঢুকে দেখি ঐ দৃশ্য। ডেকেও সাড়া না পেয়ে আপনার বন্ধুর—
কিরীটী এগিয়ে গেল। ঝুলে-পড়া হরিদাস সামন্তর মুখটা তোলবার চেষ্টা করল। কিন্তু সেটা আবার ঝুলে পড়ল বুকের উপরে।
মুখটা নীলচে। ঠোঁট দুটিও নীলচে। কশের কাছে সামান্য রক্তাক্ত ফেনা।
হাতটা তুলে নাড়ি পরীক্ষা করল কিরীটী। তারপর রাধারমণ পালের দিকে তাকিয়ে মৃদুকণ্ঠে
বললে, উনি বেঁচে নেই।
বেঁচে নেই? সে কি?
একটা চাপা আর্তনাদের মতই যেন রাধারমণ পালের কণ্ঠ হতে কথাগুলো উচ্চারিত হল।
হ্যাঁ, মারা গেছেন। কিরীটী আবার কথাটা উচ্চারণ করল।
মারা গেছেন?
কিরীটী ঐ সময় মাটি থেকে গ্লাসটা তুলে একবার নাকের কাছে নিয়ে শুকল।
তারপর সেটা পাশের একটা টুলের উপরে নামিয়ে রেখে বললে, মনে হচ্ছে কোন তীব্র বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে।
বিষ!
কথাটা কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে যেন উচ্চারিত হল শ্যামলকুমারের মুখ থেকে।
কিরীটী শ্যামলকুমারের মুখের দিকে তাকাল। শ্যামলকুমারের সমস্ত মুখে যেন একটা বিব্রত ভয়ের কালো ছায়া।
আমার তাই মনে হচ্ছে, কিরীটী বললে, পুলিসে এখুনি একটা খবর দেওয়া দরকার।
পুলিস! পুলিস কি করবে? রাধারমণ একটা ঢোক গিলে কথাটা বললেন।
স্বাভাবিক মৃত্যু নয় যখন তখন পুলিসে একটা সংবাদ দিতে হবে বৈকি।
ঘরের মধ্যে যাত্রাদলের সবাই তখন ভিড় করেছে, সবার কানেই বোধ করি সংবাদটা পৌঁছে গিয়েছিল।
জনা ষোল-সতেরো মেয়ে-পুরুষ যাত্রার দলে।
ইতিমধ্যে বোধ করি বাড়ির কর্তা রমণীমোহন কুণ্ডুর কানেও সংবাদটা পৌঁছে গিয়েছিল। ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন।
কি হয়েছে পাল মশাই? ব্যাপার কি?
রমণীমোহনের বয়স খুব বেশী নয়—পঞ্চাশ-একান্নর মধ্যেই। বেশ স্বাস্থবান দেহ। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখলে বোঝা যায় ভদ্রলোক রীতিমত শৌখিন। পরনে কাঁচির কোঁচানো ধুতি, চওড়া কালোপাড়, সাদা গিলে-করা আদ্দির পাঞ্জাবি, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি।