শ্যামলকুমার সুভদ্রাকে ডেকে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী গোড়া থেকেই লক্ষ্য করছিল আড়চোখে, শ্যামলকুমার আর সুভদ্রার দিকে জ্বলন্ত অগ্নিক্ষরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন হরিদাস সামন্ত।
মনে হচ্ছিল যেন এখুনি ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন এবং পারলে ওদের দুজনের টুটি ছিঁড়ে ফেলেন।
ওরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই হরিদাস সামন্ত যেন ফেটে পড়লেন, দেখলেন—দেখলেন তো স্বচক্ষে রায় মশাই! এরপরও বলবেন, ওরা মনে মনে আমাকে হত্যা করবার সঙ্কল্প আঁটছে না? উঃ কি সাঙ্ঘাতিক, কি ভয়ানক শয়তানী!
অধীর হবেন না সামন্ত মশাই।
অধীর হব না, কি বলছেন রায় মশাই? আমি তো একটা মানুষ, না কি?
ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তাহলেও একটা কথা কি জানেন? ওরা মনে মনে যদি কোন মতলব এঁটেই থাকে কৌশলে ওদের পথ থেকে আপনাকে সরাবার, রাগারাগি করে চেঁচামেচি করলে বা এমন করে অধৈর্য হলে ওদের তাতে করে সুবিধাই হবে।
পারছি না, এত অত্যাচার আর আমি সহ্য করতে পারছি না রায় মশাই। তাছাড়া আপনাকে তো এখনও একটা কথা বলিইনি।
কি কথা?
আজ আবার ঐ রাস্কেলটার সঙ্গে দুপুরে আমার একচোট হয়ে গিয়েছে।
কার কথা বলছেন? কিরীটী শুধাল।
কার কথা বলছি বুঝতে পারছেন না? ঐ শ্যামলকুমার!
কি হল তার সঙ্গে আবার?
জানেন, ও আমাকে আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছে আজ।
আলটিমেটাম?
হ্যাঁ। দুপুরের ট্রেনে আসতে আসতে শ্যামলকুমার আমাকে বলেছে—
কি বলেছে?
ওদের পথ থেকে যদি আমি না সরে দাঁড়াই তো ওরাই আমাকে সরাবার ব্যবস্থা করবে।
তাই নাকি!
কথাটা কয়েকদিন আগেও শ্যামলকুমার আমাকে একবার বলেছিল।
ওরাই—মানে কি? আপনার কি মনে হয়, ঐ ষড়যন্ত্রের মধ্যে সুভদ্রাও আছে?
নিশ্চয়ই আছে।
কিরীটী ক্ষণকাল যেন কি ভাবল। তারপর বলে, ঠিক আছে।
বাইরে ঐ সময় পালা শুরু হবার প্রথম বেল পড়ল।
ঐ যাঃ, প্রথম বেল পড়ল—প্রথম দৃশ্যের শেষের দিকে আমার অ্যাপিয়ারেন্স আছে। হরিদাস। সামন্ত বলে উঠলেন।
আপনি প্রস্তুত হয়ে নিন।
আপনি?
আসরে আমার বসবার একটা জায়গা করে দিন সামনের রোতে, যাতে করে ওদের দুজনকে আরও ভাল করে দেখে নাটকটা ভাল করে শুনতে পারি।
ঠিক আছে। চলুন, আপনাকে আমি বসিয়ে দিয়ে আসি। তারপর মেকআপে বসব, চলুন।
চলুন।
সামন্ত মশাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী ওঁর গ্রনরুম থেকে বেরুল।
গমগম করছিল যেন আসর।
দর্শনাথীতে একেবারে যেন ঠাসাঠাসি আসর তখন।
তিল-ধারণেরও স্থান নেই। হরিদাস সামন্ত পাল মশাইকে বলে প্রথম সারিতেই আসরের একেবারে সামনাসামনি একটা চেয়ারে কিরীটীকে বসিয়ে দিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষন পরে পালা শুরু হল।
.
কিরীটী তন্ময় হয়ে পালা শুনছিল।
নাটকটি বেশ লাগে কিরীটীর। চমৎকার লিখেছে ছেলেটি। কে বলবে একটি তরুণের ঐ প্রথম প্রয়াস।
যেমন ঘটনার বাঁধুনী তেমনি নাটকীয় সংঘাত, আর তেমনি নাটকের সংলাপ।
আরও আশ্চর্য লাগছিল কিরীটীর, হরিদাস সামন্তর কাছে কয়েকদিন আগে শোনা তাঁর জীবনকাহিনীই যেন নাটকের কাহিনীর মধ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে।
এক বৃদ্ধের এক তরুণীর প্রতি আকর্ষণ,—যে আকর্ষণের টানে সে তার নিজের সংসারকে ভাসিয়ে দিল, অথচ ঐ বৃদ্ধ ঐ তরুণীর সম্পর্কে পালিত পিতার মতই। এমন সময় নাটকে শুরু হল ওদের সংসারে এক তরুণকে নিয়ে সংঘাত।
মেয়েটি সহজেই তরুণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল স্বভাবতই, আর তাইতেই সংঘাত। এক ত্রিকোণ সংঘাত।
শেষ পর্যন্ত পালিত পিতার নিজের বিকৃত বাসনার জন্য মেয়েটির প্রতি জেগে ওঠে এক গভীর অনুশোচনা, যার ফলে সে স্থির করল সে নিজেই স্বেচ্ছায় ওদের পথ থেকে সরে দাঁড়াবে।
সে বিষপান করবে।
বিষ সংগ্রহ করে নিয়ে এল বৃদ্ধ এবং সেই বিষ সে এনে জলের পাত্রের মধ্যে ঢেলে দিল এবং মনস্থ করল মেয়েটির হাতের থেকে বিষ-মেশানো জল পান করবে, যাতে করে
সেই জল পান করলেই মৃত্যু হয়।
ক্রমশঃ নাটকের সেই দৃশ্য এল।
সুভদ্রা (নাটকের নায়িকা) কোথায় বের হয়েছিল, অনেক রাত্রে ফিরে এসে দেখে সেই বৃদ্ধ ঘরের মধ্যে একাকী চুপ করে বসে আছে।
সুভদ্রা বললে, পাশের ঘরে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গিয়েছিলাম, খেয়েছ?
আজ আর কিছু খাব না সুভদ্রা। খাবে না?
না।
শুধু এক গ্লাস জল। টেবিলের ওপরে আছে, এনে দাও তো জলের গ্লাসটা।
শুধু জল খাবে?
হ্যাঁ।
সুভদ্রা চলে গেল এবং একটু পরে এক গ্লাস জল নিয়ে এল, এই নাও জল।
যাও, তুমি শুয়ে পড়ো গে।
সুভদ্রা চলে গেল।
নিজের হাতে বিষমিশ্রিত সেই জল পানের পূর্বে বৃদ্ধের সংলাপ : সুভদ্রা, তুমি সুখী হও। আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। একটা চিঠি রেখে যাব, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
এই জলে বিষ মিশিয়ে রেখেছি তুমি জান না, তোমরা হাত দিয়েই এই বিষ আমি পান করছি। আর তাই তো তোমরা মনে মনে চেয়েছিলে—তাই হোক, তাই হোক।
সংলাপগুলো উচ্চারণ করতে করতে টলতে টলতে হরিদাস সামন্ত জলটুকু পান করে গ্লাসটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর আসর থেকে প্রস্থান করলেন।
শেষ দৃশ্য।
রাখাল-বেশী হরিদাসের প্রস্থানের পরই সুভদ্রা আর নায়কের প্রবেশ।
কিরীটী যেন নাটকের কাহিনীর মধ্যে ড়ুবে গিয়েছিল।
সুভদ্রা।
বল জ্যোতির্ময়!
আর এই খাঁচার মধ্যে বন্দী হয়ে থাকতে পারছি না।
কি করতে চাও?
এ যেন সত্যি আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে।