না, আমি কাল ভোররাত্রের টেনে বর্ধমান যাব। সুভদ্রা বললে।
বর্ধমান! বর্ধমান কেন?
সবই তোমাকে বলতে হবে নাকি? সুভদ্রার কণ্ঠে যেন বিদ্রোহের সুর।
তা বলতে হবে না! সঙ্গে বোধ হয় শ্যামলকুমার চলেছে?
চলেছে কি না চলেছে যাওয়ার সময়ই দেখতে পাবে।
সুভদ্রা, তুমি ভাব, আমি কিছুই বুঝি না।
কি বুঝেছ শুনি?
সেদিনকার পিটুনির কথা নিশ্চয়ই এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওনি?
শোন, তোমাকেও আমি স্পষ্ট করে আজ বলে দিচ্ছি, তোমার নেবুতলার বাসায় আর আমি যাব না।
উঃ! তলে তলে তাহলে বাসাও ঠিক হয়ে গিয়েছে?
সুভদ্রা কোন জবাব দিল না, যাবার জন্যই বোধ করি ঘুরে দাঁড়াল। আর দাঁড়াতেই কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল।
কে আপনি?
হরিদাস সামন্তরও দৃষ্টি ইতিমধ্যে পড়েছিল কিরীটীর উপরে।
কি হে সামন্ত, চিনতে পার।
কে?
ধূর্জটি—আমি ধূর্জটি রায় হে!
ধূর্জটি?
চিনতে পারছ না? সেই যে–
হরিদাস সামন্ত প্রথমটায় সত্যিই কিরীটীকে চিনতে পারেনি। কিরীটীর চোখ টিপে ইশারা করায় দুদিন আগেকার সব কথা তাঁর মনে পড়ে যায়। বলে ওঠেন—ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ধূর্জটি! কোথা থেকে হে?
শুনলাম তুমি পালা-গান গাইতে এসেছ—তাই ভাবলাম অনেককাল দেখাসাক্ষাৎ নেই, দেখা করে যাই।
হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার চিনেছি। উঃ, কতদিন পরে দেখা! তা বেশ—বেশ করেছ।
আজ তোমাদের পালা তো সুভদ্রা হরণ?
কথাটা বলে আড়চোখে একবার কিরীটী সুভদ্রার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ।
উনিও বুঝি তোমাদের দলে অভিনয় করেন?
হ্যাঁ। ওই-ই তো নায়িকা সাজে। ওর নাম সুভদ্রা মন্ডল।
নমস্কার। কিরীটী হাত তুলে নমস্কার করে।
সুভদ্রাও প্রতিনমস্কার জানায়।
কিরীটী বললে, পালার নামটির সঙ্গে আপনার নামটিও তো বেশ মিল করাই। পালাটা কে লিখেছে হে সামন্ত? পৌরাণিক?
না, সামাজিক জবাব দিল সুভদ্রা।
সামাজিক?
হ্যাঁ। দেখবেন না পালাটা! ভাল লাগবে পালাটা আপনার। কথাগুলো বলতে বলতে বার দুই সুভদ্রা আড়চোখে হরিদাস সামন্তর দিকে তাকাল।
কিরীটীর মনে হল সুভদ্রার ওষ্ঠের প্রান্তে যেন একটা বাঁকা হাসির চকিত বিদ্যুৎ খেলে গেল।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই দেখব, এসেছি যখন! কিরীটী বললে।
সুভদ্রা, ওকে এক কাপ চা পাঠিয়ে দাও।
তা ওহে সামন্ত, শুনেছি তোমাদের শ্যামলকুমার নাকি অদ্ভুত অভিনয় করে। তার সঙ্গে একটিবার আলাপ হয় না?
জবাব দিল সুভদ্রা, কেন হবে না? শ্যামলই তো এ নাটকের নাট্যকার। আমি এক্ষুনি শ্যামলকে ডেকে আনছি।
খুশিতে যেন ডগমগ হয়ে সুভদ্রা লঘুপদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সুভদ্রার পদশব্দ মিলিয়ে গেল বাইরে।
০৪. কিরীটী হরিদাস সামন্তর দিকে
কিরীটী হরিদাস সামন্তর দিকে ফিরে তাকাল।
এই আপনার সুভদ্রা, সামন্ত মশাই?
হ্যাঁ। কি মতলব করেছে ওরা জানেন? আজই ওরা ভোরাত্রের গাড়িতে বর্ধমান যাবে।
শুনলাম তো।
শুনেছেন?
হ্যাঁ। ঘরে ঢোকার মুখে আপনাদের শেষের কথাগুলো কানে এল।
কিন্তু আমারও প্রতিজ্ঞা, তা হতে দিচ্ছি না। সামন্ত বললেন।
সামন্ত মশাই, ও কালনাগিনী। মিথ্যে শুধু ছোবল খাবেন। যাক সেকথা। আপনাদের পালা। শুরু হচ্ছে কখন?
রাত ঠিক আটটা। এখন সাড়ে ছটা। আর দেড় ঘণ্টা বাদে।
আমাকে আসরে বসবার একটা জায়গা করে দেবেন? নিশ্চয়ই।
ভাল কথা, আপনাদের এই নাটকে কোন অঙ্কে যেন রাখালকে বিষ দেবার কথা!
বিষ কেউ দিচ্ছে না। পালায় আছে বিষ, আমিই নিজে স্বেচ্ছায় পান করব সুভদ্রা তার প্রেমিকের সঙ্গে চলে যাচ্ছে জানতে পেরে।
ওঃ, তাহলে জেনেশুনেই বিষপান? বিষপ্রয়োগ নয়? কিরীটী বললে।
হ্যাঁ, জেনেশুনেই বিষপান।
তবে—
কি তবে?
দৃশ্যটা কি রকম বলুন তো?
আমি একটা গ্লাস হাতে আসরে যাব, তাতে বিষ রয়েছে।
তারপর?
আসরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করব বিষটা, তারপর গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টলতে টলতে বের হয়ে আসব আসর থেকে।
তাহলে আসরের মধ্যে পতন ও মৃত্যু নয়?
না। নেপথ্যে।
তাহলে আর আপনার এত ভয় কেন?
মানে?
গ্লাস তো আপনিই নিয়ে যাবেন নিজে হাতে আসরে?
না।
তবে?
সুভদ্রাকে ডেকে বলব গ্লাসটা নিয়ে আসতে। সে এনে দেবে গ্লাস আসরে।
তাই নাকি! এ যে দেখছি—
কিরীটীর কথা শেষ হল না।
সুভদ্রা ও শ্যামলকুমার এসে সাজঘরে ঢুকল।
সুভদ্রার হাতে এক কাপ চা। কিরীটী দেখল, শ্যামলকুমারের বয়স আটাশ-ঊনত্রিশের বেশী হবে না।
ভারি সুশ্রী চেহারাটি। যেমন নায়কোচিত দেহের গঠন, তেমনি পুরুষোচিত স্বাস্থ্য ও যৌবন যেন কানায় কানায় উপচে পড়ছে।
কালো রং হলেও দেখতে সুন্দর। যাকে বলে সত্যিকারের সুপুরুষ। অভিনেতার মতই চেহারা বটে।
সুভদ্রা হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে কিরীটীর দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললে, এই নিন চা। এই আমাদের শ্যামলকুমার, নাটকও এরই লেখা।
আপনিই নাট্যকার?
আজ্ঞে।
এই বুঝি আপনার প্রথম নাটক? কিরীটী শুধায়।
হ্যাঁ। বিনীতভাবে জবাব দিল শ্যামল। শুনলাম আপনি সামন্তবাবুর বন্ধু। আজ আমাদের নাটকটা দেখে যান না।
এসেছি যখন দেখে যাব বৈকি।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী আবার বললে, কিন্তু নাটকের অমন একটা অদ্ভুত পৌরাণিক প্যাটার্নের নাম রাখলেন কেন শ্যামলবাবু?
শ্যামলকুমার মৃদু হেসে বললে, নাটকটা না দেখলে বুঝতে পারবেন না। আগে দেখুন, তারপর আপনার সঙ্গে আলোচনা করব। আচ্ছা তাহলে আমরা চলি। প্রথম দৃশ্যেই আমার আর সুভদ্রার প্রবেশ আছে। এস সুভা–