সুজিতের উপরে সন্দেহটা আরও বেশি ঘনীভূত হওয়ায় তার সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করলাম। কৃষ্ণনগরে খোঁজ নিতেই বের হয়ে গেল সে এককালে এক বছর আর্ট স্কুলে পড়েছিল। বুঝলাম তখন সে-ই ঐ চিঠি লিখেছে হরিদাসের হাতের লেখা নকল করে। কিন্তু কেন? What was his motive?
নজর রাখলাম সুভদ্রা ও সুজিতের উপর। দেখা গেল সুজিত যাতায়াত করে সুভদ্রার ঘরে। তার ঘরের শয্যাও সেই সাক্ষ্যই দিয়েছিল।
সুজিত তখন আর একটা চাল চালল, একটা self-inflicted injury করে দেখাতে চাইল তাকে কেউ হত্যার চেষ্টা করেছে। হাসপাতালে attending ফিজিসিয়ানের রিপোর্ট থেকেই ব্যাপারটা প্রমাণিত হয়ে গেল, কেউ তাকে ছুরি মারেনি, তাহলে ঐ ধরনের injury হতে পারে না।
যে কুয়াশাটা সুজিতকে ঘিরে ছিল সেটা এবারে সুস্পষ্ট হয়ে গেল। এদিকে ওদের দুজনের উপর থেকে নজর কিন্তু আমি সরাইনি।
সুভদ্রা অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে বুঝতে পেরেছিল তাকে আমি সন্দেহ করেছি, সেটা অবিশ্যি তাকে আমি কিছুটা কথায়বাতায় বুঝিয়েও দিয়েছিলাম এবং অনুমান করেছিলাম ঐ কারণেই যে সে এবারে নিশ্চয়ই ছুটে যাবে সুজিতের কাছে।
অনুমান যে আমার মিথ্যা নয়, প্রমাণিত হয়ে গেল। সে ছুটে গেল। যে মুহূর্তে সংবাদ পেলাম, আমরাও সুজিতের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। অবশ্য সুজিত দুটো মারাত্মক ভুল করেছিল।
সুব্রত শুধায়, কি?
কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে কিরীটী বললে, প্রথমতঃ সে অর্থাৎ সুজিত তার জবানবন্দিতে শ্যামলকুমার ও সুভদ্রার উপরে সকলের সন্দেহটা ফেলবার জন্য তাদের সে হরিদাস সামন্তর ঘরে ঢুকতে দেখেছিল কথাটা আমার কাছে বলে।
ব্যাপারটা আরও একটু স্পষ্ট করে বলি। আমি লক্ষ্য করেছিলাম তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দিকে, অর্থাৎ শুরুতে হরিদাস সামন্তর কিছুক্ষণ appearance ছিল—বোধ হয় মিনিট কুড়ির, তারপরই সে চলে আসে এবং সে সময় সুজিতের নাটকে কোন appearance ছিল না।
হিসাবমত সেটা রাত সোয়া দশটা থেকে সাড়ে দশটা। এবং আমার অনুমান সেটা কুড়ি মিনিট সময়ের মধ্যেই কোন এক সময় সুজিত সবার অলক্ষ্যে হরিদাসের সাজঘরে ঢুকে যেহেতু everything was pre-arranged- পূর্ব-পরিকল্পিত, সে প্রস্তুতই ছিল, হরিদাসের মদের বোতলে বিষ মিশিয়ে দিয়ে আসে।
সুব্রত শুধায়, সে বিষটা তাহলে—
কিরীটী বললে, ঐ সাজঘরের মধ্যেই ছিল, রাধারমণের চোখের অসুখের জন্য ডাক্তার যে eye drop দিয়েছিল তার মধ্যেই অ্যাট্রোপিন সালফেট মারাত্মক বিষ ছিল।
বিষের শিশির সবটাই সুজিত হয়তো মদের বোতলে ঢেলে শিশির মধ্যে তার বোতল থেকে মদ ঢেলে রাখে, যেটা পরে chemical analysis-এও প্রমাণিত হয়েছে। আর সেই কারণেই সুজিতের বোতলে কোন অ্যাট্রোপিন বিষ পাওয়া যায়নি analysis-এ।
কিন্তু কথা হচ্ছে, ভুলটা কি? এবং কোথায়? সুভদ্রা নাটকের তৃতীয় অঙ্কের শুরুতে আসরেই ছিল—তাই তার পক্ষে বিষ মেশানো সম্ভবপর ছিল না, অথচ সুজিত সেটা হিসাবের মধ্যে গণ্য করেনি। সে শ্যামলকুমারের সঙ্গে সুভদ্রার নাম করে একই ঢিলে দুই পাখি মারবার ফন্দিতে সুভদ্রার নামটা করেছিল! এবং সে হয়তো জানত না, হরিদাস সুভদ্রাকে টাকা দেবার জন্য তৃতীয় অঙ্কে সে যখন free থাকবে তখন তাকে একবার তার সাজঘরে যেতে বলেছিল।
সুজিত যদি ঐ মারাত্মক ভুলটা না করত, অর্থাৎ শ্যামলকুমারের সঙ্গে সুভদ্রারও নামটা আমাকে না জানাত তাহলে হয়তো তার গিল্টি কনসান্সটা অত সহজে আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠত না। সন্দেহের তার প্রতি শুরু আমার সেখান থেকেই।
মণীশ চক্রবর্তী বললেন, তবে সুজিতই হরিদাস সামন্তকে বিষ দিয়েছিল?
হ্যাঁ। কিরীটী বললে, সুজিত মিত্রই। তবে সুভদ্রা বোধ হয় সুজিতকে হরিদাস সামন্তর সাজঘর থেকে বেরুবার সময় দেখে ফেলেছিল। যে কারণে তার মনে তার প্রতি সন্দেহ জাগে।
কৃষ্ণা বললে, তবে সুভদ্রা সে কথা তোমাকে জানায়নি কেন তার জবানবন্দিতে?
কিরীটী বললে, ভুল তো তোমার সেইখানেই হয়েছে কৃষ্ণা।
ভুল! কৃষ্ণা স্বামীর মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। তুমি ভুলে গিয়েছিলে যে সুজিতকে সুভদ্রা প্রথমদিকে ভালবাসলেও, সুজিত যখন অর্থের লোভে অনায়াসেই তাকে হরিদাস সামন্তর মত এক প্রৌঢ় কামুকের হাতে তুলে দিল সে ভালবাসার আর অবশিষ্ট মাত্রও ছিল না–থাকতে পারে না, নারীর মন সে ব্যাপারে বড় কঠিন। অথচ সুজিতের কবল থেকে মুক্তিরও তখন আর তার কোন উপায় ছিল না।
আশ্চর্য! একবারও আমার সে কথা মনে হয়নি।
কিরীটী বললে, জানি, আর সেই ভুলেই তোমার কাগজে হয়তো লিখে রেখেছ হত্যাকারী সুভদ্রা, তাই না?
হ্যাঁ।
কিরীটী হাসল।
কিরীটী আবার বলতে শুরু করল, যাক যা বলছিলাম, সুজিত যে মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিল সুভদ্রার মন শ্যামলকুমারের দিকে ঝুঁকেছে এবং পরস্পর পরস্পরকে ভালবেসেছে, সুভদ্রার গর্ভে হরিদাসের সন্তান থাকা সত্ত্বেও, তখনই সে স্থির করে তার plan of action—একই সঙ্গে শ্যামল ও সুভদ্রাকে সরাতে হবে। কারণ সে তো বুঝেছিলই—সুভদ্রা হরিদাসের কাছে না থাকলে তাকে দোহন আর চলবে না। শ্যামলকুমারকে দোহন করা সম্ভবপর হবে না।
মল্লিক সাহেব শুধালেন, তারপর? বলুন, থামলেন কেন মিঃ রায়? কিরীটী আবার বলতে লাগল, শ্যামল ও সুভদ্রা দুজনকেই একসঙ্গে কেমন করে ফাঁসানো যায় ভাবতে ভাবতেই হয়তো সুজিত ঐ পথটি বেছে নিয়েছিল and plan was succesful—কেউ ধরতে পারত না তাকে অত সহজে, যদি না সে আগ বাড়িয়ে ওদের দুজনের নাম করে বসত আমার কাছে।