সুভদ্রা তার মাসীর আশ্রয় থেকে পালিয়ে যখন যায় তখনই সুজিতের সঙ্গে তার সামান্য পরিচয়। সুজিত সুভদ্রাকে ঠিকমত আইনানুগভাবে কোনদিন বিবাহ করেছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু সুভদ্রার বোধ হয় তা সত্ত্বেও সুজিতের উপর একটা দুর্বলতা ছিল, আর সে দুর্বলতাটুকুর পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছিল শয়তান সুজিত।
সুজিতের চরিত্রে নানা দোষ ছিল, তার মধ্যে রেসের মাঠ ও জুয়া-অভিনয় সে ভালই করত, কিন্তু ঐ মারাত্মক নেশার দাস হওয়ায় তার সে প্রতিভা নষ্ট হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে চেহারাটাও খারাপ হয়ে যায় চারিত্রিক উচ্ছলতার জন্য। সে ক্রমশঃ পারফেক্ট ভিলেনে রূপান্তরিত হয়।
এদিকে সুভদ্রাও তাকে ছাড়বে না, সুজিতের পক্ষেও তার ভার বয়ে চলা সম্ভব নয়। তখন সুজিতই এক উপায় বের করল। সুভদ্রার অভিনয়ের নেশা ছিল, সে তাকে নিয়ে গিয়ে হাজির করল পাল মশাইয়ের কাছে। বেশ চলছিল এবং চলতও হয়তো দুজনের, কিন্তু মাঝখানে প্রৌঢ় হরিদাস সামন্ত পড়ে সব গোলমাল করে দিল।
হরিদাস সামন্তর লোভ পড়ল সুভদ্রার যৌবনের প্রতি। সে আকৃষ্ট হল এবং শয়তান সুজিত তখন দেখল ব্যাপারটায় তার লাভ বই ক্ষতি নয়। সে আর এক কৌশলে সুভদ্রাকে হরিদাস সামন্তর হাতে তুলে দিয়ে হরিদাসকে শোষণ শুরু করল।
হরিদাস টাকা যোগাতে লাগল, সুভদ্রার বোধ হয় ব্যাপারটা আগাগোড়াই পছন্দ হয়নি, সে অনন্যোপায় হয়ে শয়তান সুজিতের শাসানিতে হরিদাসের রক্ষিতা হয়ে রইল।
কয়েক বছর বেশ ঐভাবেই হয়তো চলছিল, তারপরই ব্যাপারটা হরিদাসের কাছে ফাঁস হয়ে গেল।
কিন্তু কেমন করে ফাঁস হল, সেটাও অবিশ্যি আমার অনুমান, হরিদাস সামন্ত হঠাৎ কোন এক সময় সুভদ্রার গলার হারের লকেটটা বোধ হয় পায়। সেই লকেটের মধ্যে ছিল সুভদ্রা ও সুজিতের যুগল ফটো। হরিদাস ব্যাপার বুঝতে পেরে (আমার অনুমান অবশ্য) সুভদ্রাকে তিরস্কার করে এবং টাকা দেওয়া বন্ধ করে। কারণ সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল সুভদ্রার হাত দিয়েই সুজিত তাকে শোষণ করে চলেছে।
সুজিত ব্যাপারটা জানতে পারল। এবং সে তখন হরিদাসকে নিশ্চয়ই শাসায়, প্রাণভয়ে ভীত হরিদাস তখন আমার কাছে ছুটে আসে। কিন্তু সব কথা স্পষ্ট করে বলতে সাহস পায় না।
তবে সব কথা না বললেও স্পষ্ট করে আভাসে যেটুকু বলে তাতে আমার বুঝতে কষ্ট হয় না, তার বিপদ যাত্রাদলের মধ্যেই।
সন্দেহটা আমার আরও ঘনীভূত হয় সুভদ্রা হরণ নাটকের বিষয়বস্তু শুনে। তবে একটা কথা এখানে অস্বীকার করব না, শ্যামলকেই প্রথমে নাটকের বিষয়বস্তু শোনার পর সন্দেহ করি, তাই আমি নাটকটা দেখতে যাই।
সুব্রত প্রশ্ন করে, কিন্তু সুজিতকে তুই সন্দেহ করলি কখন?
সুজিতকে ঠিক প্রথমটায় সন্দেহ করিনি—কিরীটী বলতে থাকে, এইমাত্র তো বললাম আমার প্রথম সন্দেহ পড়ে শ্যামল ও সুভদ্রার উপরে। তাদের উপরেই আমি নজর রেখেছিলাম। কিন্তু বিষ ও চুড়ির টুকরো আমার মনের চিন্তাধারাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করে।
হরিদাস সামন্তকে মদের সঙ্গে বিষ দেওয়া হয়েছিল, শ্যামল মদ্যপান করে না, কিন্তু সুজিত মদ্যপানে অভ্যস্থ ছিল—তাতেই মনে হয় আর যে-ই বিষ দিক না কেন মদের সঙ্গে মিশিয়ে, শ্যামল নয়, শ্যামল যদি বিষ না মিশিয়ে থাকে মদে তবে আর কে মেশাতে পারে—আর কে ঐ ব্যাপারে, অর্থাৎ হরিদাসকে পৃথিবী থেকে সরানোর ব্যাপারে interested থাকতে পারে।
প্রথমেই তারপর মনে হয়েছিল সুভদ্রার কথা। কিন্তু যে মুহূর্তে বুঝতে পারলাম সুভদ্রা অন্তঃসত্ত্বা, তখুনি বুঝলাম সুভদ্রা তাকে বিষ দেয়নি, তার গর্ভের সন্তানের জন্মদাতাকে সে বিষ দেবে না।
কিরীটী একটু থেমে আবার বলতে লাগল, হরিদাস সুজিতকে টাকা দেওয়া বন্ধ করায় হরত সুজিত তাকে চাপ দিচ্ছিল, অথচ নিজের জালে জড়িয়ে সুভদ্রারও আর টাকা দেবার জন্য হরিদাসকে অনুরোধ করবার উপায় ছিল না। এমন সময় হয়ত একটা কথা তার মনে হয়েছিল, হরিদাসকে যদি বোঝাতে পারে গর্ভের সন্তান হরিদাসেরই তখন হয়ত হরিদাস আবার সুজিতকে টাকা দিতে পারে, সুভদ্রার প্রতি সন্দেহটা যেতে পারে, তাই আমার মনে হয়েছিল সুভদ্রা হরিদাসকে বিষ দেয়নি।
কাজেই সুভদ্রা যদি বিষ না দিয়ে থাকে তবে আর কে হতে পারে! শ্যামলও নয়—তাছাড়া শ্যামল তো সুভদ্রার মন পেয়েছিলই—সে কেন তবে হরিদাসকে হত্যা করতে যাবে? তাহলে আর কেহঠাৎ তখন মনে পড়ল সুজিতের কথা। সুজিতই সুভদ্রাকে যাত্রার দলে এনেছিল। Then why not সুজিত?
ঐ পথেই তখন চিন্তা শুরু করলাম। মনে আরও সন্দেহ জাগল সুজিত সম্পর্কে, কারণ সে-ই বলেছিল সে-রাত্রের জবানবন্দীতে, সে নাকি সুভদ্রা ও শ্যামলকে হরিদাসের সাজঘরে সে-রাত্রে ঢুকতে দেখেছিল। মনে হল তবে কি ওদের উপরে সন্দেহ জাগানোর জন্যই সুজিত ওদের নাম করেছিল।
মনের মধ্যে কথাটা দানা বাঁধতে শুরু করল। তারপর ঐ চিরকুটটা—যেটা রাধারাণী ভোলাকে দিয়েছিল শ্যামলকে দিতে।
নাটকের পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় হরিদাসের হাতের নোটিস্ ছিল, সে লেখার সঙ্গে চিরকুটের লেখা যখন মিলল না, তখন বুঝতে বাকি রইল না চিরকুটটা জাল এবং শ্যামলকে ফাঁসানোর সেটা আর একটা ষড়যন্ত্র।
কার লেখা তবে চিরকুটটা! কে লিখতে পারে! শ্যামল নয়—তবে আর কে? আমার মনে হল, why not সুজিত?