কিরীটী পূর্ববৎ শান্ত গলায় বললে, অ্যাট্রোপিন সালফেট, যার থেকে দু গ্রেনেই অবধারিত মৃত্যু একজন মানুষের।
বলেন কি!
তাই এবং সে বিষ তাঁকে তাঁর মদের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু কে—কে তাকে মদের সঙ্গে বিষ দিতে পারে? ব্যাপারটা আত্মহত্যা নয় তো! Suicide!
না। শান্ত গলায় কঠিন না শব্দটা যেন উচ্চারিত হল কিরীটীর কণ্ঠ হতে, ব্যাপারটা আদৌ আত্মহত্যা নয়।
নয় কি করে জানলেন?
জেনেছি, এবং সে প্রমাণও আমার কাছে আছে। কথাটা বলে পুনরায় কিরীটী সুভদ্রার দিকে তাকাল।
সুভদ্রা যেন পাথর।
সে যেন কেমন অসহায় বোবা দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কিরীটীর দিকে।
সুভদ্রা দেবী, আপনি সম্ভবতঃ জানেন ব্যাপারটা, আপনিই বলুন না-হরিদাসবাবুকে মদের সঙ্গে বিষ কে দিতে পারে বা কার পক্ষে সম্ভব ছিল সে-রাত্রে?
আমি-আমি কি করে জানব?
কিন্তু আমার মনে হয় সুভদ্রা দেবী, ব্যাপারটা আপনি জানলেও জানতে পারেন।
আমি?
হ্যাঁ—বলুন সুভদ্রা দেবী, কে সে-রাত্রে সামন্ত মশাইয়ের মদের সঙ্গে বিষ দিতে পারে? কিরীটীর গলার স্বর তীক্ষ্ণ।
সুভদ্রা, সত্যি তুমি জান? প্রশ্ন করল এবার সুজিত।
না, না। বলুন সুভদ্রা দেবী,বলুন—কারণ, রাত সাড়ে দশটা এগারোটার মধ্যে অর্থাৎ তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে সে-রাত্রে আপনি হরিদাসবাবুর ঘরে দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন।
প্রমাণ–
হ্যাঁ, এই ভাঙা-বলতে বলতে পকেট থেকে সে-রাত্রে সাজঘরে কুড়িয়ে পাওয়া কাচের আয়না-বসানো চুড়ির টুকরোটা বের করে বললে, চুড়ির টুকরোটাই সে প্রমাণ দেবে, দেখুন তো, চিনতে পারছেন কি না, এই ভাঙা টুকরোটা যে চুড়ির সেটা সে-রাত্রে অভিনয়ের সময় আপনার হাতে ছিল—
সুভদ্রা বোবা।
এখন বলুন সুভদ্রা দেবী, দ্বিতীয়বার কেন আপনি আবার সে-ঘরে গিয়েছিলেন?
আ—আমি যাইনি। বিশ্বাস করুন—
গিয়েছিলেন। শান্ত কঠিন গলা কিরীটীর। বিষ মেশানো মদের বোতলটা সরিয়ে আনবার জন্য, তাই না?
আমি কিছু জানি না।
জানেন। বলুন সে বোতলটা কোথায়?
আমি জানি না–কিছু জানি না–বলতে বলতে সুভদ্রা সুজিতের দিকে তাকাল।
স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেন কি? আমার দিকে তাকিয়ে বলুন। কিরীটী আবার বললে।
কি বলছেন? উনি আমার স্বামী হতে যাবেন কেন? সুভদ্রা বলে ওঠে।
নন বুঝি! কিরীটীর কণ্ঠে যেন একটা চাপা ব্যঙ্গের স্বর, কি সুজিতবাবু, উনি আপনার স্ত্রী নন? অবিশ্যি এখনও জানি না বিবাহটা দশ বছর আগে আপনার কোন মতে হয়েছিল। হিন্দুমতে পুরুত ডেকে, না রেজিস্ট্রি করে, না শৈবমতে, না কেবল কালীঘাটে গিয়ে সিঁদুর ছুঁইয়ে—
কোন মতেই আমাদের বিবাহ হয়নি। কি সব পাগলের মত যা-তা বলছেন। সুজিত বলে ওঠে।
আমি পাগল, তাই না! এবারে বলুন সুভদ্রা দেবী, আপনার গলার হীরের লকেটটা কোথায় গেল? কিরীটী বললে।
লকেট! কিসের লকেট?
আপনার গলায় যে সরু হারটা আছে তার সঙ্গে একটা লকেট ছিল, লকেটটা কোথায়? সেই লকেটটা যে হরিদাসবাবুর হাতে গিয়ে পড়েছিল সেটা জানতে পেরেই বোধ হয় মরীয়া হয়ে উঠেছিলেন, যেহেতু বুঝেছিলেন আসল সত্যটা তাঁর কাছে ফাঁস হয়ে গেছে, তাই না? এতদিনের অভিনয়টা আপনাদের ধরা পড়ে গেছে তাই ভেবে মরীয়া হয়ে, না সুভদ্রা দেবী—উঁহু, কোমরে হাত দেবার চেষ্টা করবেন না। আমি জানি কোমরে দোক্তার কৌটোর মধ্যে দোক্তার সঙ্গে কি মেশানো আছে।
সুভদ্রা হাতটা কোমর থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হল।
সুব্রত, সুভদ্রা দেবীর কোমরে দোক্তার কৌটোটা গোঁজা আছে, ওটা নিয়ে নে।
সুব্রত এগিয়ে গিয়ে সুভদ্রার কোমরে গোঁজা দোক্তার ছোট্ট কৌটোটা ছিনিয়ে নিল।
আমি জানি সুভদ্রা দেবী, অবশ্যই অনুমানে নির্ভর করে, সুজিতবাবু আজ যদি আপনার গর্ভের সন্তানকে স্বীকৃতি না দিতেন তাহলে আপনি শেষ পথটাই নিতেন।
হঠাৎ হাঃ হাঃ করে সুজিত হেসে উঠে বললে, চমৎকার একটা নাটক রচনা করেছেন তো কিরাটীবাবু!
সত্যিই নাটকটা চমৎকার সুজিতবাবু, আপনার ভিলেনের রোলটিও অপূর্ব হয়েছে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত। তবে জানেন তো, সব নাটকেই ভিলেনের শেষ পরিণতি হয় জেল, নয় ফাঁসি!
কিরীটীর কথা শেষ হল না, অকস্মাৎ যেন বাঘের মতই ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা ধারাল ছোরা কোমর থেকে টেনে নিয়ে সুজিত কিরীটীর উপরে।
কিন্তু কিরীটী অসতর্ক ছিল না, চকিতে সে সরে দাঁড়ায়।
সুজিত হুমড়ি খেয়ে দেওয়ালের উপর গিয়ে পড়ে গেল। সুব্রত সেই সুযোগটা হেলায় হারায় না, লাফিয়ে পড়ে সুজিতের উপর। সুজিতের সাধ্য ছিল না সুব্রতর শারীরিক বলের কাছে দাঁড়ায়। তাই সহজেই সুব্রত তাকে চিৎ করে ফেলে মাটিতে।
কিরীটী তার পকেটে যে বাঁশীটা ছিল তাতে সজোরে ফুঁ দিল।
মল্লিক সাহেব তাঁর দলবল নিয়ে প্রস্তুতই ছিলেন কিরীটীর পূর্ব নির্দেশ মত বাড়ির সামনে, সকলে ছুটে এল ঘরে।
.
পরের দিন সকালে দুই প্রস্থ চা হয়ে গিয়েছিল।
তৃতীয় প্রস্থের সঙ্গে কিরীটী, সুব্রত, মল্লিক সাহেব, মণীশ চক্রবর্তী ও কৃষ্ণা—কিরীটীর বাড়ির বসবার ঘরে হরিদাস সামন্তর মৃত্যুর ব্যাপারেই আলোচনা চলছিল।
আলোচনা ঠিক নয়।
একজন বক্তা। সে কিরীটী। এবং অন্য সকলে শ্রোতা। কিরীটী বলছিল : ব্যাপারটা সত্যিই একটা রীতিমত নাটক। এবং নাটকের শুরু নবকেতন যাত্রা পার্টিতে সুভদ্রার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এবং শেষ সুজিতের হাতে হাতকড়া পড়ার সঙ্গে।