কোন্ দৃশ্য?
কলেজের মাঠে খেলা হচ্ছিল, ও ছিল গোলকীপার। বরাবরই ওর চেহারাটা ছিল। কুমড়োপটাসের মত, সেই চেহারা আর সাতটা গোল খেয়েছিল, তাইতেই মনে আছে ওকে। তারপর বহুকাল পরে চন্দননগরে একটা সাহিত্য-সভায় ওর সঙ্গে পরিচয় হল। এখন আবার একজন কবি।
ফুটবল থেকে কবিতা—অসাধারণ উত্তরণ! এ যে আরও দুর্ধর্ষ ব্যাপার!
তাই—তবে মাঝখানটা বাদ দিলি কেন? দারোগা। গত মোল বছর। ভদ্রলোকের এক কথা এক কাজ। ঐ দারোগাগরিতেই আটকে আছে, এক ধাপও অগ্রসর হয়নি। ভদ্রলোক দেখলাম তোর উপরে ভীষণ খাপ্পা।
কেন? আমি আবার কি করলাম?
কি একটা যাত্রাদলের লোকের খুনের ব্যাপারে নাকি তুই তার উপরওয়ালার সাহায্যে নাক। গলিয়ে ব্যাপারটাকে প্রায় ভণ্ডুল করে দিতে বসেছিস?
কেন, সে তো এইমাত্র শুনলাম—
কি শুনলি?
ফোনে মল্লিক বললে, রাধারমণ পালকে নাকি সে অ্যারেস্ট করেছে, তার মতে সে-ই নাকি খুনী।
কিন্তু ব্যাপারটা কি? শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। সুব্রতর কণ্ঠে আগ্রহের সুর।
আমি ততক্ষণে স্নানটা সেরে আসি, তুই কৃষ্ণার কাছে সব শোন্।
কিরীটী উঠে গেল ঘর থেকে।
আধঘণ্টা পরে স্নান সেরে একবারে বেরুবার পোশাকে সজ্জিত হয়ে কিরীটী ঘরে এল।
কি রে, শুনলি?
শুনলাম, আর এও বুঝলাম মণীশ চক্রবর্তী আর একটা গোল খেয়ে বসে আছে।
বুঝলি কি করে? কৃষ্ণার সঙ্গে মত বিনিময় হল বুঝি? বলতে বলতে আড়চোখে কিরীটী স্ত্রীর দিকে তাকাল।
না, তোর গৃহিণী তো কবুল করল না কিছুতেই। সুব্রত হাসতে হাসতে বললে।
তাহলে তুই একটু বোস, আমি একটু ঘুরে আসি।
কতদূর যাবি? সুব্রত শুধায়।
বেশি দূর না–কাছাকাছি।
ঐ সময় ঘরের টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নেয়, কিরীটী রায়—
আমি মণীশ চক্রবর্তী কথা বলছি।
কি খবর বলুন? অ্যাঁ! কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে বোতলে কিছু পাওয়া যায়নি? গ্লাসে এবং স্টমাক কনটেন্টে বিষ পাওয়া গিয়েছে?
কি বিষ?…অ্যাট্রোপিন সালফেট? ঠিক আছে। হ্যাঁ, ভাল কথা—সন্ধ্যার দিকে একবার ফোন করবেন। কিরীটী ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল।
সুব্রত শুধাল, কি? অ্যাট্রোপিন সালফেট বিষ পাওয়া গিয়েছে?
হ্যাঁ, অ্যাট্রোপিনের লিথাল ডোজটা বোধ হয়—এক থেকে দুই গ্রেন–কৃষ্ণা, ঐ আলমারি থেকে ডাঃ ঘোষের ফারমাকোপিয়াটা বের কর তো, ঐ যে লাল মলাটের বইটা—একেবারে ডান দিকে শেষে, দ্বিতীয় থাকে—
কৃষ্ণা আলমারি থেকে বইটা বের করে এনে কিরীটীর হাতে দিল। কিছুক্ষণ ধরে পাতা উল্টে উল্টে এক জায়গায় এসে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। পড়তে লাগল।
একটু পরে বইটা বন্ধ করে কৃষ্ণার হাতে দিতে দিতে বললে, আশ্চর্য! লোকটা ঐ বিশেষ বিষটা যে এত দ্রুত এত অল্প ডোজে কার্যকরী, তা জানল কি করে?
কিরীটী পুনরায় বসে সোফার উপর, একটা সিগারেট ধরায়।
কৃষ্ণা, তোমাকে বলেছিলাম না দুদিন পরে মীমাংসা হবে?
হ্যাঁ!
তার আর দরকার হবে না বোধ হয়, মিসিং লিঙ্কটা পেয়ে গিয়েছি।
সত্যি!
বোস্ সুব্রত তুই, যাস নে। ঘণ্টা দেড়েক-দুয়েকের মধ্যে ঘুরে আসছি।
বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল, চললাম।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
১৩. কলিং বেলের শব্দে
কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দিয়ে সুভদ্রা যেন একটু অবাকই হয়, কিরীটীবাবু আপনি!
হ্যাঁ, একটা কথা গত সন্ধ্যায় জিজ্ঞাসা করা হয়নি। চলুন না ভিতরে।
আসুন। অনাসক্ত গলায় সুভদ্রা কিরীটীকে যেন আহ্বান জানালে।
গত রাত্রের সেই ঘর। শয্যাটা এলোমেলো হয়ে আছে এখনও। তখনও গুছিয়ে পাট করা হয়নি শয্যাটা।
কিরীটী একবার আড়চোখে শয্যাটা দেখে নিলে। শুনলাম শ্যামলবাবু যাত্রাদলের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন? কিরীটী কথাটা বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুভদ্রার মুখের দিকে তাকাল।
তাই নাকি! শুনিনি তো–কে বললে?
শুনলাম। তাহলে আপনিও বোধ হয় ঐ দল থেকে চলে যাবেন?
না। তা কেন যাব?
যাবেন না! শ্যামলবাবু চলে যাবেন, অথচ আপনি—
তার যদি না পোয় তো সে চলে যাবে, আমি চাকরি ছাড়তে যাব কেন?
শ্যামলবাবু যদি আপত্তি করেন?
করবে না—আর করলেই বা!
তা আপনাদের বিয়েটা কবে হচ্ছে?
বিয়ে?
হ্যাঁ, শ্যামলবাবুর আর আপনার?
হন্তদন্ত হয়ে ঐ সময় রাধারমণ পাল এসে ঘরে ঢুকল, সুভদ্রা, শুনেছ?
রাধারমণ পাল কিরীটীকে লক্ষ্য করেনি প্রথমটায়, কিন্তু কথাটা বলতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ে গেল কিরীটীকে।
একটু থেমে, যেন থতমত খেয়ে বললে, কিরীটীবাবু, আপনি?
কি হয়েছে পাল মশাই? কিরীটী শান্ত গলায় প্রশ্ন করল।
সুজিতকে গতরাত্রে সে যখন বাড়ি ফিরছে, তার গলির মধ্যে কারা যেন পিছন থেকে ছোরা মেরেছে।
সে কি! একটা ভয়ার্ত স্বর যেন বের হয়ে এল সুভদ্রার কণ্ঠ থেকে।
রাতে কখন? কিরীটী আবার শান্ত গলায় প্রশ্ন করল, মানে রাত কটা হবে?
ও তো বলছে রাত প্রায় বারোটা সোয়া-বারোটা হবে।
সুজিতবাবু এখন কোথায়?
বাঙ্গুর হাসপাতালে—কেবল একটু আগে হাসপাতাল থেকে আমাকে অফিসে ফোন করেছিল।
কে?
সুজিত।
আঘাতটা খুব বেশি হয়েছে?
কিরীটী পুনরায় শান্ত গলায় প্রশ্ন করে।
না, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছে। বাঁ দিককার ঠিক কাঁধের নীচে নাকি হাতের উপর দিয়ে গিয়েছে।
এখন তিনি কোথায়?
তার বাসা কালীঘাটে। আমি তো সেখান থেকেই আসছি।
প্রাণের কোন আশঙ্কা নেই তো পাল মশাই? সুভদ্রা এতক্ষণে প্রশ্ন করে।