পনের মিনিট কুড়ি মিনিট প্রায় কাটতে চলেছে, সুভদ্রা কখন থেকে এক কাপ চা নিয়ে বসে আছে সেই কোণের টেবিলের চেয়ারটায়। হঠাৎ কিরীটীর দৃষ্টি সজাগ হয়ে উঠল।
একজন এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে রেস্টুরেন্টের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। এবং অল্পক্ষণ পরেই সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে এল।
সুভদ্রার সঙ্গের লোকটিকে চিনতে, অন্য ফুটপাতে দাঁড়িয়েও, রেস্টুরেন্টের উজ্জ্বল আলোয় কিরীটীর এতটুকু অসুবিধা হয় না।
চোখের তারা দুটো তার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একটা আরামের নিঃশ্বাস নেয় কিরীটী এতক্ষণে যেন, তাহলে অনুমান তার মিথ্যা নয়।
কিরীটীর প্রয়োজন শেষ হয়ে গিয়েছিল।
হীরা সিংকে বাগবাজারের মোড়ে পেট্রোল পাম্পটার সামনে গাড়ি পার্ক করে রাখতে বলে এসেছিল, এগিয়ে গেল কিরীটী সেইদিকে।
গাড়িতে উঠে বসে কিরীটী বললে, চল হীরা সিং, কোঠি।
রাত প্রায় পৌনে এগারটায় কিরীটী তার গৃহে এসে পৌঁছল।
কোথায় গিয়েছিলে? কৃষ্ণা শুধায়, এত রাত হল যে?
সোফার উপরে আরাম করে বসতে বসতে কিরীটী বললে, দাঁড়াও, অনেকক্ষণ ধূমপান করিনি। বলতে বলতে পকেট থেকে একটা সিগার বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করল।
কফি খাবে?
মন্দ কি!
বসো, কফি আনি। ঘরের মধ্যে ঠাণ্ডা মেসিন চলার দরুন ঘরটা ঠাণ্ডা ও আরামদায়ক।
১২. কফির শূন্য কাপটা নামিয়ে
মিনিট দশেক পরে কফির শূন্য কাপটা নামিয়ে রাখতেই কৃষ্ণা আবার প্রশ্ন করল, কোথায় গিয়েছিলে?
বল তো কোথায়?
মনে হয় সুভদ্রা-নিকেতনে!
বাঃ, চমৎকার কৃষ্ণা! তোমার দেখছি তৃতীয় নয়নটি রীতিমত খুলে গিয়েছে!
বাঃ, এত বড় একজন রহস্যভেদীর সঙ্গে এতকাল বাস করছি! কথায় বলে সাধুসঙ্গে স্বর্গবাস!
আর অসৎ সঙ্গে–বলতে বলতে কিরীটী হেসে ওঠে।
সত্যি বল না গো?
কি বলব?
আমার অনুমানটা কি মিথ্যে?
না, একেবারে মিথ্যে নয়। তবে—
তবে?
আর দুটো দিন অপেক্ষা কর দেবী, আশা করছি তারপরই হরিদাস সামন্ত হত্যারহস্যের উপরে যবনিকাপাত হয়ে যাবে। এখনও সামান্য বাকি, দুটি বা একটি দৃশ্য।
বিশ্বাস করি না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ কে হত্যাকারী!
সত্যের অপলাপ করা কর্তব্য নয়, তা বুঝতে পেরেছি বোধ হয়।
বোধ হয় না, বুঝতে তুমি পেরেছ ঠিকই।
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসে।
উঃ, তোমার পেট থেকে কথা বের করা না—ঠিক আছে, বলো না। তবে আমিও বুঝতে পেরেছি হত্যাকারী কে?
বুঝতে যদি পেরে থাক তবে আবার প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ কেন, দেবী?
মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম, আমার অনুমান ঠিক কিনা।
ঠিক আছে, তাহলে এস আমরা দুজনেই হত্যাকারীর নাম দুটো আলাদা আলাদা কাগজে লিখে আমার ড্রয়ারে রেখে দিই চাবি বন্ধ করে, তারপর চাবিটা
ঐ সময় জংলী এসে ঘরে ঢোকে শূন্য কফির কাপ দুটো নিয়ে যেতে।
কিরীটী জংলীর দিকে তাকিয়ে বললে, ড্রয়ারের চাবিটা থাকবে শ্রীমান জংলীর হেপাজতে। পরশু রাত ঠিক এগারোটা দশ মিনিটে চাবি নিয়ে কাগজ খুলে মিলিয়ে দেখা যাবে কার অনুমান সত্য। কেমন, রাজী?
রাজী।
জংলী হাঁ করে ওদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে কিছুক্ষণ পরে বলে, কি হল মাইজী!
কৃষ্ণা ততক্ষণে উঠে টেবিলের উপর থেকে দুটো কাগজ আর কলম এনে বললে, নাও, তুমি লেখো। আমিও লিখছি।
তথাস্তু দেবী।
জংলী তখনও বোকার মত ওদের দিকে তাকিয়ে।
দুজনের লেখা হলে, দুখানা কাগজ ভাঁজ করে চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলে সে দুটো ড্রয়ারের মধ্যে ফেলে চাবি বন্ধ করে, ড্রয়ারের চাবিটা জংলীর হাতে দিয়ে কৃষ্ণা বললে, এই চাবিটা রাখ তোর কাছে জংলী।
কেন মাইজী?
যা বলছি—রাখ। আমি চাইলেও দিবি না, বাবু চাইলেও দিবি না, বুঝলি? ঘুষ দিলেও নয়।
জংলী বুঝতে পারে কোন একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। সে মিটিমিটি হাসতে হাসতে চাবিটা পকেটে রাখতে রাখতে বললে, ঠিক হ্যায় কিসিকো এ কুঞ্জী নেহী দুংগা।
.
পরের দিন সকালে চা-পানের পর কিরীটী যেন কার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে ফোনে।
কৃষ্ণা পাশেই সোফায় বসে একটা স্কার্ফ বুনছিল, কিরীটীর ফোন শেষ হলে বললে, সুব্রতর খবর কি বল তো?
কিরীটী একটা সোফায় বসে সামনের সুদৃশ্য একটি কাশ্মীরী কৌটো থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাতে ধরাতে বললে, মাসখানেক প্রায় দেখা নেই, তাই না!
হ্যাঁ ও যেন কেমন হয়ে গিয়েছে।
বিয়ে না করলে পুরুষমানুষ এমনই হয়ে যায়।
হঠাৎ ঐ সময় ঘরের ফোনটা বেজে উঠল। কিরীটী উঠে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিল।
মল্লিকের ফোন।
মণীশ কি করেছে শুনেছ!
কি? …তাই নাকি! ভালই তো। কিরীটী হাসতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে ফোন রেখে ফিরে এসে আবার বসল কৃষ্ণার মুখোমুখি। হ্যাঁ, কি যেন বলছিলে? বিয়ে না করলে কি হয়ে যায়, কৃষ্ণা—
কিরীটীর কথা শেষ হল না, ঐ সময় দরজা ঠেলে সুব্রত ঘরে ঢুকল, মুখে স্মিত হাসি।
আরে তুই-তোর পায়ের শব্দ পাইনি তো! কিরীটী বললে।
তাহলে দেখছি মণীশ চক্রবর্তী ঠিকই বলেছে—সুব্রত হাসতে হাসতে মুখোমুখি বসে বললে।
মণীশ চক্রবর্তী?
হ্যাঁ, চন্দননগর থানার ও সি।
তুই চিনিস নাকি ওকে?
আমরা যখন বাঁকুড়া কলেজে পড়তাম তখন ও বাঁকুড়া স্কুলে পড়ত, দুর্ধর্ষ ফুটবল প্লেয়ার ছিল।
গোলকীপার বুঝি? কিরীটী স্মিতহাস্যে বলল।
ঠিক বলেছিস। কিন্তু বুঝলি কি করে? বলতে বলতে হেসে ওঠে সুব্রত।
হাসলি যে?
সুব্রত বললে, সেই দৃশ্যটা মনে পড়ল তোর কথায়।