দেখেছেন বইকি রায় মশাই।
দেখেছি?
হ্যাঁ।
এককালে স্টেজে অভিনয় করতাম তো।
রঙমহল মঞ্চে—
হ্যাঁ। ছিলাম অনেক দিন।
উল্কা নাটকে আপনি অভিনয় করেছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ। রাজীব ঘোষের ভূমিকায়। মনে আছে আপনার সে অভিনয়?
হ্যাঁ। মনে আছে বৈকি। তা মঞ্চ ছেড়ে দিয়েছেন বুঝি?
হ্যাঁ।
কেন, মঞ্চ ছেড়ে দিলেন কেন?
আমাদের যুগ যে চলে গিয়েছে।
যুগ চলে গিয়েছে কি রকম?
তাছাড়া কি? আমরা তো এখন ডেড়-ফসিল। তবে ওই অ্যাটিংয়ের নেশা জানেন তো কি ভয়ানক! তাই থিয়েটারের মঞ্চ ছেড়ে গিয়ে যোগ দিলাম যাত্রার দলে।
যাত্রার দলে?
হ্যাঁ। যাত্রা। তারপর একদিন পার্টনারশিপে আধাআধি হিস্যায় নবকেতন যাত্রা পার্টি গড়ে তুললাম।
কতদিন হল যাত্রার দলে অভিনয় করছেন?
তা ধরুন বছর সাত-আট তো হলই প্রায়। প্রথমটায় বছর দুয়েক এ-দলে ও-দলে গাওনা গেয়ে বেড়িয়েছি। তারপর দেখলাম এ লাইনে বাঁচতে হলে নিজের দল গড়া ছাড়া উপায় নেই। তাই–
নিজের দল খুললেন?
হ্যাঁ। নবকেতন যাত্রা পার্টি—
নবকেতন যাত্রা পার্টি আপনি গড়েছিলেন?
ঠিক আমি একা নই। আমি আর রাধারমণ পাল মশাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বছর দুই বাদে শেয়ার বেচে দিয়ে পাল মশাইয়ের দলেই বর্তমানে চাকরি করছি।
জংলী ঐ সময় দুকাপ চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।
থিয়েটারে অভিনয় ব্যাপারে কিরীটীর বরাবর একটা নেশা আছে। নতুন নাটক কখনও কোনও মঞ্চে সে বড় একটা বাদ দেয় না। হরিদাস সামন্তর অভিনয় সে রঙ্গমঞ্চে বার দুই দেখেছে। সেও বছর সাত-আট আগে। কিন্তু সে চেহারা নেই হরিদাস সামন্তর। সে চেহারা যেন শুকিয়ে গিয়েছে। তাহলেও ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চেনা-চেনা মনে হয়েছিল সেই কারণেই।
নিন সামন্ত মশাই, চা খান।
চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে হরিদাস সামন্ত বললেন, আমার অভিনয় আপনি তো দেখেছেন রায় মশাই?
দেখেছি।
প্রথম যুগের অভিনয় হয়ত আমার দেখেননি।
দেখেছি। আপনার সিরাজদৌল্লায় সিরাজের পার্ট।
আর কিছু?
রত্নদীপে সোনার হরিণ।
দেখেছেন?
হ্যাঁ।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন হরিদাস সামন্তর বুক কাঁপিয়ে বের হয়ে এল।
বললেন, হ্যাঁ—সে সময় হিরো থেকে ক্যারেক্টার রোল পর্যন্ত করতাম—
আবার যেন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল সামন্তর।
তারপর ধীরে ধীরে বললেন, আশ্চর্য! এখনও আপনার সে কথা মনে আছে? আপনি গুণী ব্যক্তি, তাই অন্যের গুণের কথা আজও স্মরণ রেখেছেন। কেউ মনে রাখে না রায় মশাইনটনটীদের কেউ মনে রাখে না। গিরিশচন্দ্র ঠিকই বলে গিয়েছেন—দেহপটসনে নট সকলই হারায়। কথাগুলো বলতে বলতে হরিদাস সামন্তর চোখের কোণ দুটো সজল হয়ে ওঠে।
কিন্তু আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন তা তো কই এখনও বললেন না সামন্ত মশাই।
হ্যাঁ—বলব। আর সেই জন্যই তো এসেছি। রায় মশাই, আপনার রহস্য উদঘাটনের অদ্ভুত ক্ষমতার, শক্তির কথা আমি জানি। আর তাতেই সর্বাগ্রে আপনার কথাই মনে হয়েছে। আমার সামনে যে বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, তা থেকে মুক্ত যদি কেউ করতে পারে আমাকে একমাত্র আপনিই হয়ত পারবেন।
সামন্ত মশাই, জানি না আপনার কি ধরনের বিপদ উপস্থিত হয়েছে, তবে আমার যদি সাধ্যাতীত না হয়, যথাসাধ্য আপনার আমি নিশ্চয়ই সাহায্য করবার চেষ্টা করব।
কিরীটীর বিরক্তির ভাবটা ততক্ষণে অনেকখানি কেটে গিয়েছে। বলতে কি সে যেন একটু কৌতূহলই বোধ করে সামন্ত মশাইয়ের কথায়।
পারবেন রায় মশাই, কেউ যদি পারে তো একমাত্র আপনিই পারবেন। আপনাকে সব কথা খুলে না বললে গোড়া থেকে আপনি বুঝতে পারবেন না। তাই গোড়া থেকেই বলছি।
০২. হরিদাস সামন্ত অতঃপর
হরিদাস সামন্ত অতঃপর বলতে শুরু করলেন তাঁর কাহিনী।
থিয়েটারে নতুন নতুন সব ছেলেছোকরা অভিনেতাদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই হরিদাস সামন্তদের মত বয়স্ক অভিনেতাদের চাহিদা কমতে শুরু করেছিল।
তার অবিশ্যি আর একটা কারণও ছিল। নতুন অভিনেতারা সব নতুন ঢঙে অভিনয় করে যা আগের দিনের অভিনেতাদের সঙ্গে আদৌ মেলে না।
পাবলিকও চায় নতুন ধরনের অভিনয় আজকাল।
অবিশ্যি হরিদাস সামন্তর ডিমান্ড কমে যাওয়ার আরও একটা কারণ ছিল। অতিরিক্ত মদ্যপান ও আনুষঙ্গিক অত্যাচারে শরীরটা যেন কেমন তাঁর ভেঙে শুকিয়ে গিয়েছিল, বয়সের আন্দাজে বেশ বুড়োই মনে হত তাঁকে।
বয়সের জন্যই তাঁকে হিয়োর রোল থেকে আগেই সরে আসতে হয়েছিল। শেষে ক্যারেক্টার রোল থেকেও ক্রমশঃ তাঁকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল।
এবং শেষ পর্যন্ত একদিন যখন হরিদাস বুঝতে পারলেন মঞ্চের প্রয়োজন তাঁর জন্য ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে—এবং হয়ত শীঘ্রই একদিন নোটিশ পেতে হবে-হরিদাস সামন্ত নিজেই স্টেজ থেকে সরে গেলেন।
একটা সুযোগও তখন এসে গিয়েছিল।
নিউ অপেরা যাত্রাপার্টি থেকে তাঁর ডাক এল। মাইনেটাও মোটা রকমের। হরিদাস সামন্ত সঙ্গে সঙ্গে আগত লক্ষ্মীকে সাদরে বরণ করে নিলেন।
ঐ সময়টায় যাত্রার দলগুলো আবার নতুন করে বাঁচবার চেষ্টা করছিল। মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তারা দলে মোটা মাইনে দিয়ে টানতে শুরু করেছিল। অনেকে সেজন্য যাত্রার দলে নাম লেখাতে শুরু করেছিল। সেখানেই অভিনেত্রী সুভদ্রার সঙ্গে পরিচয়।
অভিনেত্রী বললে ভুল হবে, কারণ সুভদ্রা তখন মাত্র মাস আষ্টেক ঐ যাত্রার দলে যোগ দিয়েছে। নয়া রিক্রুট। রেফিউজী কলোনীর মেয়ে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা। সুভদ্রার বয়স তখন কুড়ি-একুশের বেশী নয়। পাতলা দোহারা, গায়ের বর্ণ শ্যাম কিন্তু চোখ-মুখের ও দেহের গড়নটি ভারি চমৎকার। যৌবন যেন সারা দেহে উপচে পড়ছে।