কি জানি মশাই, তাই তো দিত।
আচ্ছা পাল মশাই, সুজিতবাবুর সঙ্গে দোলগোবিন্দবাবুর সম্প্রীতি কেমন ছিল?
দুজনের বলতে পারেন সাপে-নেউলের সম্পর্ক, ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত।
আর একটা কথা–বলতে বলতে কিরীটী পকেট থেকে কাগজের একটা ভাঁজ-করা টুকরো বের করল, আপনি তো হরিদাস সামন্তর অনেক দিনের পরিচিত, দেখুন তো এই লেখাটা—তাঁরই হাতের লেখা কিনা?
দেখি। রাধারমণ পাল ভাঁজ-করা কাগজটা হাতে নিলেন, চোখে চশমা দিয়ে বেশ ভাল করে দেখলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, এটা কোথায় পেলেন?
মনে নেই। সে-রাত্রে শ্যামলবাবু দিয়েছিলেন—এই সেই চিরকুট যেটা রাধা দেবী শ্যামলের হাতে দেবার জন্য চাকর ভোলাকে দিয়েছিল।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। চিরকুটে লেখা-শ্যামল, একবার দেখা করবে সময় পেলেই, জরুরী দরকার।
কি মনে হয় পাল মশাই, লেখাটা সামন্ত মশাইয়েরই তো?
সেই রকমই তো হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছে।
ঠিক বলতে পারছেন না? আচ্ছা, হরিদাসবাবুর কোন হাতের লেখা আপনার কাছে আছে?
সে রকম কিছু নেই।
কোন চিঠি বা—
দাঁড়ান, মনে পড়েছে, সুভদ্রা হরণ নাটকের পাণ্ডুলিপির মধ্যে মধ্যে হরিদাসের হাতে correction ও suggestion লেখা আছে, যা সে রিহার্সেলের সময় লিখেছিল!
দেখতে পারি একবার নাটকের পাণ্ডুলিপিটা?
নিশ্চয়ই। ভামিনী, আলমারি থেকে পাণ্ডুলিপিটা বার করে দাও তো। এই নাও চাবি।
পাল মশাই পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বের করে দিলেন।
কৃষ্ণভামিনী নিঃশব্দে উঠে গিয়ে চাবি দিয়ে আলমারি খুলে নাটকের পাণ্ডুলিপিটা বের করে
র করে এনে দিল।
কিরীটী উল্টে-পাল্টে কিছুক্ষণ কয়েকটা পাতা দেখল, তারপর বললে, পাল মশাই!
বলুন।
পাণ্ডুলিপিটা আমি নিয়ে যাব।
নিয়ে যান ও অভিশপ্ত পাণ্ডুলিপি, ও এঘরে থাকলে হয়ত আরও অমঙ্গল হবে।
কৃষ্ণভামিনী দেবী!
কিরীটীর ডাকে মহিলাটি ওর মুখের দিকে তাকাল।
এক কাপ চা খাওয়ান।
কৃষ্ণভামিনী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
পাল মশাই!
আজ্ঞে?
আমার দুটো ঠিকানা চাই।
ঠিকানা!
হ্যাঁ, সুভদ্রা ও হরিদাসবাবু কোথায় থাকতেন সেই বাড়ির ঠিকানা, আর সুজিতবাবুর বাসার ঠিকানা।
সুভদ্রা আর হরিদাস পাল স্ট্রীটে থাকত—তিন/দুই, আর সুজিত কালীঘাটে থাকে, মহিম হালদার স্ট্রীটে।
খাতা দেখে অতঃপর সঠিক ঠিকানা দুটো বলে দিলেন রাধারমণ, কিরীটী টুকে নিল নোটবুকে।
আর একটা কথা—
বলুন?
সুজিতবাবুই তো একদিন সুভদ্রাকে আপনার দলে এনেছিলেন?
হ্যাঁ।
এবারে দোলগোবিন্দবাবুকে একবার ডাকুন।
আর কাউকে?
না।
রাধারমণ পাল ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন এবং একটু পরে দোলগোবিন্দকে নিয়ে এসে ঢুকলেন।
১০. রোগা প্যাঁকাটির মত চেহারা
রোগা প্যাঁকাটির মত চেহারা। তোবড়ানো গাল, কোটরগত চক্ষু দীর্ঘ অত্যাচারের সাক্ষ্য দেয়। দুই চোখে ভীত-সন্ত্রস্ত চাউনি।
আপনারই নাম দোলগোবিন্দ? কিরীটীর প্রশ্ন।
আজ্ঞে, সিকদার।
আপনার সেরাত্রে লাস্ট সিনে চাকরের পার্টে প্রক্সি দেওয়ার কথা ছিল না?
আজ্ঞে।
তবে যাননি কেন?
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘু
মিয়ে পড়েছিলেন!
হ্যাঁ, মানে, ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। ঘু
মোতে ঘুমোতেই বুঝি কোথাও চলে গিয়েছিলেন?
আজ্ঞে!
তবে সে রাত্রে অত খুঁজেও আপনাকে পাওয়া গেল না কেন?
আজ্ঞে, পুকুরের পাড়ে—
পুকুরের পাড়ে!
হ্যাঁ, বড্ড গরম, তাই পুকুরের ধারে সিঁড়ির উপরে গিয়ে বসেছিলাম একটু। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।
তারপর ঘুম ভাঙল কখন?
পরের দিন সকালে?
তারপর কি করলেন?
তখন শুনলাম হরিদাসদা খুন হয়েছেন—সেই শুনে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম।
কার কাছে শুনলেন?
রাধার কাছে।
পাল মশাই, রাধা দেবীকে ডাকুন তো!
রাধারমণ কিরীটীর নির্দেশে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন আবার। ঠিক ঐ সময় কৃষ্ণভামিনী এক কাপ চা হাতে ঘরে এসে ঢুকল।
চা—
রাখুন ওখানে।
কৃষ্ণভামিনী চায়ের কাপটা পাশের একটা টুলের উপরে নামিয়ে রাখল।
রাধারাণী এসে ঘরে ঢুকল রাধারমণ পালের সঙ্গে।
রাধারাণী দেবী আপনার নাম?
আজ্ঞে।
আপনি দোলগোবিন্দবাবুকে পরের দিন সকালবেলা দিঘির পাড়ে দেখেছিলেন?
কে বললে?
কেন উনি বলছেন?
ও মাগো, কোথা যাব গো—হ্যাঁরে হাড়হাবাতে অলপ্পেয়ে অনামুখখা, তোর সঙ্গে আমার দেখা হল পরের দিন সকালে কখন রে?
রাধা, মানে তুই–
দোলগোবিন্দর মুখের কথাটা শেষ হতে পারল না।
রাধা চোখ পাকিয়া চিৎকার করে উঠল, বদমায়েসী করবার আর জায়গা পাওনি হতচ্ছাড়া ড্যাকরা! খেংরে বিষ ঝেড়ে দেব তোমার!
সে কি রাধা, তুমি আমায় বললে না—দেখুন স্যার, ও মিথ্যে বলছে, নচেৎ আমি জানব কি করে যে হরিদাসদা খুন হয়েছে?
রাধারাণী প্রায় তখুনি ঝাঁপিয়ে পড়ছিল দোলগোবিন্দর উপর, কিরীটী বাধা দিল, থামুন। থামুন, কি করছেন আপনারা, যান রাধারাণী দেবী, আপনি এ ঘর থেকে চলে যান।
রাধারাণী গজরাতে গজরাতে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
দোলগোবিন্দবাবু! কিরীটী ডাকল।
কেঁদে ফেললে দোলগোবিন্দ, বিশ্বাস করুন স্যার, আমি কিছু জানি না, কিছু দেখিনি সে-রাতে। ওসব খুনোখুনির মধ্যে আমি ছিলাম না।
আপনি সে-রাতে সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে কোথায় ছিলেন দোলগোবিন্দবাবু, অর্থাৎ তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি সময়?
ঠিক মনে পড়ছে না। কাঁদতে কাঁদতে বললে দোলগোবিন্দ।
মনে পড়ছে না?
আজ্ঞে না।
ঐ সময় হরিদাসবাবুর ঘরে গেছেন একবারও?
না তো!
কাউকে সে-ঘরে যেতে দেখেছেন?