চন্দননগরে সে রাত্রে ঐ অভিনেত্রীটিকেও কিরীটী দেখেছিল। নাম কৃষ্ণভামিনী।
বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে, মোটাসোটা গড়ন।
দুজনে মুখোমুখি দুটি তক্তপোশের উপর বসে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে যেন কি আলোচনা করছিল, কিরীটীর পদশব্দে মুখ তুলে তাকাল।
কিরীটীর আজ ছদ্মবেশ ছিল না।
তাই বোধ হয় প্রথমটায় কিরীটীকে চিনতে পারেন না পাল মশাই। কুঞ্চিত করে তাকালেন, কি চাই?
পাল মশাই, নমস্কার।
নমস্কার। কোথা থেকে আসছেন?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, চিনতে পারছেন না বোধ হয়?
না।
আমি ধূর্জটি রায়।
আপনি—বিস্ময়ে পাল মশাইয়ের গলাটা যেন বাকরোধ হয়ে যায়।
হ্যাঁ, সেটা ছিল আমার ছদ্মবেশ!
ছদ্মবেশ!
হ্যাঁ, সামন্ত মশাইয়ের আমন্ত্রণেই ঐ ছদ্মবেশে সেদিন চন্দননগরে আমায় যেতে হয়েছিল।
বুঝলাম না ঠিক। আমার আসল নামটা হয়তো শুনে থাকবেন—কিরীটী রায়।
রহস্যানুসন্ধানী কিরীটী রায়!
হ্যাঁ।
তা আপনি–
বললাম তো, সামন্ত মশাইয়ের কেমন ধারণা হয়েছিল তাঁর জীবন বিপন্ন, তাই তিনি আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
তথাপি রাধারমণ পালের নিজেকে সামলে নিতে একটু সময় লাগল। কৃষ্ণভামিনীও চেয়ে ছিল কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটা আবার বললে, সেদিন বলেছিলাম আসব এখানে—
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বসুন, বসুন।
ঘরটি মাঝারি সাইজের, একধারে একটি তক্তপোশ পাতা সতরঞ্চি বিছানো, গোটাকয়েক তাকিয়া, মাঝখানে একটি টানাওয়ালা নীচু ডেস্ক।
অন্য পাশে একটি কাঠের আলমারি। খানকয়েক চেয়ার ও টুল।
দেওয়ালে দু-তিনটে ক্যালেণ্ডার, একটি গ্রুপ ফটো।
ঘরের মধ্যে বেশ একটি উজ্জ্বল শক্তির বাতি জ্বলছিল।
রাধারমণ পাল তক্তপোশ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলেন ইতিমধ্যে। বললেন, বসুন রায় মশাই।
আপনার দলের আর সবাইকে দেখছি না?
সবাই আছে পাশের ঘরে। রাধারমণ পাল বললেন, ভামিনী, শঙ্করকে ডেকে চায়ের কথা বল।
ব্যস্ত হবেন না পাল মশাই। চায়ের এখন প্রয়োজন নেই। কিরীটী বললে।
দল বোধ হয় উঠেই যাবে রায় মশাই। রাধারমণ বললেন এরপর।
কেন?
আর কেন—শ্যামল চলে যাচ্ছে, নোটিস দিয়েছে, সামন্ত মশাই নেই, বুঝতেই পারছেন শ্যামলও চলে গেলে–
সুভদ্রাও কি নোটিস দিয়েছে নাকি? কিরীটী শুধাল।
না, দেয়নি এখনও, তবে শ্যামল না থাকলে সুভদ্রাও যে থাকবে না সে তো জানা কথাই। তা বটে! আর সুজিতবাবু?
না, ও বোধ হয় যাবে না। হরিদাস চলে গেল, শ্যামল আর সুভদ্রা চলে গেলে কাকে নিয়ে আর পালা গাওয়াব?
ভাল কথা, দোলগোবিন্দবাবুর কোন সংবাদ পেলেন?
সে ফিরে এসেছে। এসেছে!
তা সেদিন রাত্রে হঠাৎ গা-ঢাকা দিয়েছিলেন কেন?
ভয়ে।
কিরীটী মৃদু হাসল।
সেই আলোচনাই করছিলাম ভামিনীর সঙ্গে বসে। একদিন আমি, হরিদাস আর কৃষ্ণভামিনী তিনজনে মিলে দল গড়েছিলাম। আমার আর হরিদাসের আধাআধি বখরা। শেষ পর্যন্ত হরিদাস বখরা বেচে দিল আমাকে।
হরিদাসবাবুর মুখে সে-কথা শুনেছি।
শুনেছেন!
হ্যাঁ।
কি যে হল, হঠাৎ বখরা বেচে দিল।
সবাইকে আজ এখানে উপস্থিত থাকতে বলেছিলাম—
সবাই এসেছে—সবাই পাশের ঘরে আছে, কার কার সঙ্গে আপনি কথা বলতে চান বলুন, আমি ডাকছিনা, সবাইকে ডাকব?
সবাইকে ডাকার একসঙ্গে প্রয়োজন নেই, সকলকে আমার প্রয়োজনও নেই। আচ্ছা সেরাত্রে হরিদাসবাবুর সাজঘরের পাশের দুটি সাজঘরে কারা কারা ছিল বলতে পারেন?
হরিদাসের সাজঘরের ডান দিকের সাজঘরে ছিল সুজিত আর কৃষ্ণধন।
কৃষ্ণধন?
হ্যাঁ, কৃষ্ণধন চাটুজ্যে। ঐ যে লম্বা ঢ্যাঙা মত, নায়কের বন্ধুর রোল করেছিল নাটকে!
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আর বাঁদিককার ঘরে?
সুভদ্রা আর এই কৃষ্ণভামিনীর সাজঘর ছিল। আর বাকি সব একটা বড় সাজঘরে ছিল। মধ্যবর্তী দরজা ছিল একটা দুঘরের মধ্যে।
কিরীটী কি যেন চিন্তা করে।
ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী হরিদাস সামন্তর মৃত্যু হয়েছিল রাত সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে, অর্থাৎ তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে। পালা শুরু হয়েছিল ঠিক রাত সাড়ে সাতটায়।
পাল মশাই!
আজ্ঞে?
রাত সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত—আপনি কোথায় ছিলেন ঐ এক ঘণ্টা সময়?
ঠিক মনে পড়ছে না।
তৃতীয় অঙ্ক শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টা কোথায় ছিলেন মনে করে দেখুন!
আমি প্রথম দিকে আসরেই ছিলাম, তারপর হঠাৎ মনে পড়ল হরিদাস একশো টাকা চেয়েছিল, সেই টাকাটা দেবার জন্য নিজের ঘরে চলে আসি।
সেই সময় সে ঘরে আর কে ছিল?
আমি আর দোলগোবিন্দবাবু।
দোলগোবিন্দবাবু তাঁর সাজঘরে না থেকে আপনার ঘরে ছিলেন কেন?
তার পার্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই তার সাজঘরে না থেকে আমার ঘরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিল বোধ হয়।
ভাল কথা, পাল মশাই—
বলুন?
দোলগোবিন্দবাবুর রেস খেলা অভ্যাস আছে, তাই না?
হ্যাঁ, ঐ ঘোড়া রোগেই তো ওর সব খেয়েছে। হরিদাসের ছিল মদ আর মেয়েমানুষ, আর দোলগোবিন্দর মদ আর ঘোড়া। নচেৎ দুজনেরই অসাধারণ অভিনয়-প্রতিভা ছিল।
দুজনের মধ্যে খুব সদ্ভাব–মানে সম্প্রীতি ছিল বুঝি?
তা তো ছিল বলেই মনে হয়।
দোলগোবিন্দবাবুকে হরিদাসবাবু প্রায়ই টাকা ধার দিতেন, তাই না?
দিত, কিন্তু শুনলেন কোথায়?
শুনেছি। এবং সে টাকা তিনি শোধ করতেন না।
রেস খেলে সব ওড়াত, টাকা শোধ করবে কোথা থেকে?
টাকা কখনও দোলগোবিন্দবাবু শোধ করতেন না, অথচ হরিদাসবাবু তাঁকে টাকা দিয়েই যেতেন!