খুব ভাল করছেন। কাচের গ্লাস আর বোতলটাও পাঠিয়েছেন তো?
হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে বললেন, আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানেন কিরীটীবাবু?
কি বলুন তো?
ঐ দোলগোবিন্দ না কি যেন নাম—যে সে রাত্রে হঠাৎ গা-ঢাকা দিয়েছে, এ তারই কীর্তি। নিশ্চয় তারই কীর্তি।
হতে পারে। তা হঠাৎ তারই উপরে সন্দেহটা পড়ছে কেন বিশেষ করে?
নচেৎ ব্যাটা হঠাৎ গা-ঢাকা দিলে কেন? কিন্তু যাবে কোথায়? আমি লোক লাগিয়েছি—ঠিক ধরবই ব্যাটাকে।
ব্যাপারটা স্রেফ ভয় বা নার্ভাসনেসও তো হতে পারে মিঃ চক্রবর্তী।
না, না কিরীটীবাবু—আপনি যাই বলুন, এতকাল খুনে ডাকাতদের নিয়ে কারবার করছি—ও মশাই সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। আরও একটি লোককে আমার সন্দেহ হয়, ব্যাটা একটি বাস্তু ঘুঘু–
কার কথা বলছেন?
কার আবার—ঐ রাধারমণ পাল, দলের অধিকারী, কেমন ভিজে বেড়ালটির মত হাবভাব দেখাচ্ছিল!
ভদ্রলোক প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছিল বুঝতে পারেননি?
ওটা স্রেফ অভিনয়। বুঝতে পারলেন না, ও দুটোকেই আমি ভাবছি অ্যারেস্ট করব। অ্যারেস্ট করে থানায় এনে চাপ দিলেই দেখবেন স্বীকার করতে পথ পাবে না। হুঁ, বলে কত দেখলাম। মল্লিক সাহেবকে আমি বলে দিয়েছি দুটো দিন অপেক্ষা করুন স্যার, ও রহস্যের মীমাংসা। আমি করে এনেছি প্রায়।
হুঁ, তাহলে শ্যামলকুমারের উপর থেকে সন্দেহটা আপনার গেছে? হঠাৎ কিরীটী বলল।
যায়নি একেবারে, তবে—
তবে?
অতটা আর নেই, তবু তার উপরে আমার চোখ আছে বৈকি।
কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ঐ ধরনের হত্যার একটা মোটিভ—উদ্দেশ্য থাকে, আপনার মনে হয় এ ক্ষেত্রে মোটিভটা কি?
মোটিভ? বুঝতে পারলেন না—কথাটা বলে একটু বিজ্ঞের হাসি হেসে মণীশ চক্রবর্তী কিরীটীর দিকে তাকালেন।
না, ঠিক বোধ হয় এখনও বুঝিনি।
ওদের দুজনেরই strong motive আছে।
যথা?
আজ সকালে দোলগোবিন্দর ছোট ভাইকে থানায় ডেকে আনিয়েছিলাম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। সে কি বললে জানেন? দোলগোবিন্দ লোকটা নাকি যেমন মাতাল তেমনি একের নম্বরের জুয়াড়ি।
মাতাল, জুয়াড়ি?
হ্যাঁ।
Rare combination বলতেই হবে। তবে পাল মশাইও যেন অমনিই কিছু বলছিলেন।
জানেন শনিবার শনিবার ঘোড়দৌড়ের মাঠে সে যেত, আর সেই ব্যাপারেই হরিদাস সামন্তর কাছে তাকে হাত পাততে হত।
হরিদাস সামন্ত টাকা দিত?
দিত।–হ্যাঁ, খেপে খেপে অনেক টাকা তাকে দিয়েছিল ধার সামন্ত, যার একটা পয়সাও নাকি শোধ করেনি আজ পর্যন্ত দোলগোবিন্দ।
টাকা ধার দিত? টাকা ফেরত পাবে না জেনেও টাকা ধার দিত? আশ্চর্য!
তাই তো শুনলাম। পাল মশাইকেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনিও তাই বললেন। এখন বুঝতে পারছেন, সেই টাকা যাতে কোনদিন দোলগোবিন্দকে শোধ করতে না হয় তাই কৌশলেই হয়তো সে হরিদাস সামন্তকে-and that was the motive–
সরিয়ে দিয়েছে বলতে চান?
ব্যাপারটা কি খুব অসম্ভব!
হুঁ, আর রাধারমণ পাল—তার কি স্বার্থ?
আমার কি মনে হয় জানেন?
কি?
লোকটার ঐ সুভদ্রা মেয়েটার উপরে লোভ ছিল।
লোভ?
কেন, থাকতে পারে না? অমন ডবগা ছুঁড়ি, চেহারাখানা ভাবুন তো একবার।
মনে হচ্ছে আপনারও মনে যেন দোলা লাগিয়েছে সুভদ্রা! মৃদু হেসে কিরীটী সকৌতুকে বললে।
যাঃ, কি যে বলেন।
আহা, এতে লজ্জার কি আছে মিঃ চক্রবর্তী! ভাল জিনিস সকলের মনকেই আকর্ষণ করে।
মণীশ চক্রবর্তী সলজ্জ হাসি হাসেন।
০৯. সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হবার পরে
পরের দিন।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হবার পরেই কিরীটী চিৎপুরে রাধারমণ পালের যাত্রা-পার্টির অফিসে গিয়ে হাজির হল। গ্রীষ্মের রাত আটটা—সন্ধ্যাও বলা চলে সবে।
ঐ অঞ্চলটা যেমন ঘিঞ্জি, তেমনি নোংরা, তেমনি মানুষের ভিড়। ট্রাম-বাস-ট্যাক্সি-রিকশা ও ঠেলাগাড়িতে যেন গিজগিজ করছে।
গাড়ি থেকে নেমে কিরীটী হীরা সিংকে বলে, আশেপাশে কোথাও পার্ক করে রাখ।
এ অঞ্চলটা শহরের বোধ হয় সবচাইতে বেশী পুরনো। সেকেলে ধরনের সব দোতলা তিনতলা বাড়ি, গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যে মধ্যে সরু গলি। গলির মোড়ে চা
ও পান-সিগারেটের দোকান। রাস্তাটা যেমন সংকীর্ণ তেমনি নোংরা।
নবকেতন যাত্রা-পাটির অফিস খুঁজে পেতে বেশ একটু সময়ই লাগল। তিনতলা একটা বাড়ি, তার মধ্যে অনেক ঘর। দোতলায় নবকেতন যাত্রা পার্টির অফিস। নীচের তলাটা অন্ধকার। ভাঙা সরু সিঁড়ি, অন্ধকার। বারোয়ারী সিঁড়িতে আলোর বলতে গেলে কোন ব্যবস্থাই নেই।
পকেট থেকে সরু পেনসিল-টচটা বের করে তারই সাহায্যে কোনমতে কিরীটী দোতলায় উঠে গেল।
আরও দুটি যাত্রা-পাটির অফিস দোতলায়। হৈ-চৈ করে গান-বাজনা আর অভিনয়ের মহলা চলেছে। সরু রেলিং-ঘেরা বারান্দা বারান্দাটা দক্ষিণ-উত্তর ঘুরে পশ্চিম-উত্তরে চলে গিয়েছে। দক্ষিণের শেষ দুটো ঘরেই নবকেতন যাত্রা-পাটির অফিস। একটা ছোকরা একগাদা মাটির ভাঁড় ও একটি চায়ের কেতলী দিয়ে বারান্দা দিয়ে আসছিল, তাকেই কিরীটী শুধাল, নবকেতন যাত্রা-পাটির অফিস কোষ্টা?
ঐ যে স্যার, এগিয়ে যান না।
ছোকরাটি কিরীটীকে কথাটা বলে নিজের কাজে চলে গেল।
কিরীটী এগিয়ে গেল।
দরজা খোলাই ছিল। ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছিল।
দরজার পাশে দেওয়ালে টিনের সাইনবোর্ড লাগানো–নবকেতন যাত্রা-পার্টি।
ভিতরে প্রবেশ করল কিরীটী।
ঘরের মধ্যে দুটি লোক ছিল।
চিনতে তাদের কষ্ট হয় না কিরীটীর, একজন অধিকারী রাধারমণ পাল মশাই, আর একটি স্ত্রীলোক।