মৃত্যু আশঙ্কা!
হ্যাঁ, তাঁর ধারণা হয়েছিল তাঁকে হত্যা করা হবে।
কে—কে তাঁকে হত্যা করবে?
হত্যা যে কেউ তাঁকে করেছে সে তো দেখতেই পাচ্ছেন, ঐ সামনে তাঁর বিষ-জর্জরিত মৃতদেহ—আর এও আমি জানি–
কি—কি জানেন?
আপনারা যাঁরা আজ রাত্রে এখানে উপস্থিত হয়েছেন অভিনয়ের ব্যাপারে—সেই আপনাদের মধ্যেই কেউ একজন তাঁকে হত্যা করেছেন।
কিরীটী শান্ত ধীর গলায় কথাগুলো বলে গেল।
কে—কে তাঁকে হত্যা করেছে?
আপনিই অনুমান করুন না, কে তাঁকে হত্যা করতে পারে!
ঐ সময় মণীশ চক্রবর্তী পুনরায় এসে ঘরে ঢুকলেন, হাতে তাঁর একটি গালার চুড়ি।
একটিই পেয়েছেন—জোড়ার অন্যটা পাননি তো? কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
না, একটিই পেলাম।
জানতাম পাবেন না। সুভদ্রা দেবী, জোড়ার অন্য চুড়িটা কোথায় গেল? সুভদ্রার দিকে ফিরে তাকিয়ে কিরীটী তার কথাটা প্রশ্নের ভিতর দিয়ে শেষ করল।
জা—জানি না, ওখানেই তো খুলে রেখেছিলাম!
না, রাখেননি।
রাখিনি—কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি—অন্যটা ভেঙে গিয়েছে!
ভেঙে গিয়েছে।
হ্যাঁ, তৃতীয় অঙ্ক শুরু হবার পরই কোন এক সময় ভেঙে গিয়েছিল। কারণ তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি সময় আমার এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে, হাতে আপনার চুড়ি ছিল। তা কি করে ভাঙল?
সুভদ্রা চুপ। একেবারে যেন বোবা, বিমূঢ়।
জবাব দিন—এই ঘরের মধেই, না? কিন্তু ভাঙল কি করে?
হ্যাঁ, এই ঘর থেকে বেরুবার সময় দরজায় ধাক্কা লেগে চুড়িটা ভেঙে যায়।
আপনি মিথ্যে কথা বলছেন, যেমন একটু আগে বলেছিলেন, পেরেকে হাত কেটেছেন!
কিন্তু—
বলুন সত্যি কথাটা?
মিথ্যে আমি বলিনি।
বলেছেন। এবার বলুন তো—আপনি সন্তানসম্ভবা, তাই—
হ্যাঁ। মাথাটা আবার নীচু করল সুভদ্রা।
কার সন্তার আপনার গর্ভে?
সামন্ত মশাইয়ের।
তিনি জানতেন কথাটা?
জানতেন।
আশ্চর্য! অস্ফুট স্বরে কথাটা কিরীটী উচ্চারণ করল।
কি বললেন?
কিছু না। আপনি যেতে পারেন। পাল মশাইকে এ ঘরে পাঠিয়ে দিন।
সুভদ্রা ঘর ছেড়ে চলে গেল।
রাত শেষ হয়ে আসছিল। গ্রীষ্মের স্বল্পায়ু রাত্রি। খোলা জানলাপথে একটা ঠাণ্ডা ঝিরঝিরে হাওয়া আসছিল।
রাধারমণ পাল এসে ঘরে ঢুকলেন।
ইতিমধ্যেই কিরীটীর পরামর্শে মণীশ চক্রবর্তী একটা চাদরে মৃতদেহটা ঢেকে দিয়েছিলেন চেয়ার থেকে নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেন পাল মশাইয়ে মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে।
আমায় ডেকেছেন?
পাল মশাই!
কিরীটীর ডাকে রাধারমণ পাল ওর মুখের দিকে তাকালেন।
একটা কথা জিজ্ঞাসা করি।
বলুন?
সুজিতবাবুকে আজ আপনি একটা পাইণ্ট বোতল দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
অভিনয়ের রাত্রে আপনি প্রত্যেক বারই দিতেন?
আজ্ঞে।
পাল মশাই, একটা কাজ আপনাকে করতে হবে। কিরীটী বললে।
কি বলুন?
আপাতত যতদিন না সামন্ত মশাইয়ের মৃত্যুরহস্যের একটা মীমাংসায় পুলিস পৌঁছায় ততদিন আপনার দলের কয়েকজন কলকাতার বাইরে কোথাও যেতে পারবেন না। ভাল কথা, দোলগোবিন্দবাবু আছেন তো, তাঁকে একবার যদি ডেকে দেন, কয়েকটা প্রশ্ন তাঁকে করতে চাই।
না মশাই, তার কোন সন্ধানই পাচ্ছি না।
সন্ধান পাচ্ছেন না?
না।
আপনি জানেন না তিনি কোথায় গিয়েছেন?
না। হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়ার কারণও তো কিছু বুঝতে পারছি না।
কিরীটী একটু যেন কি ভাবল, তারপর বললে, তিনি তো অনেক দিন আপনার দলে আছেন?
হ্যাঁ, তা ধরুন প্রায় বছর সাতেক তো হবেই। তবে মনে হচ্ছে—
কি?
ফ্রেঞ্চ লিকারের সন্ধানে বোধ হয় গিয়েছে। সারাটা দিনই উসখুস করছিল। কিন্তু আমি যেতে দিইনি। নেশা করলে ওর হুঁশ থাকে না। পার্ট করতে পারবে না। নচেৎ সে পালাবার লোক নয়। নেশা একটু বেশি করে বটে—লোকটা সাদাসিধে, ঘোরপ্যাঁচ তেমন কিছু নেই।
আপনার দলের সকলেরই বোতল-প্রীতি রয়েছে। কিরীটী বললে।
আজ্ঞে।
আর কে কে মদ্যপান করে থাকেন এ দলে?
সবাই করে অল্পবিস্তর।
শ্যামলকুমার?
বলতে পারি না।
আপনি?
না, জীবনে আজ পর্যন্ত মদ স্পর্শ করিনি।
হুঁ। তাহলে ঐ কথাই রইল, ওরা যেন কলকাতার বাইরে না যায়।
কিন্তু আপনি দলের কাদের কথা বলছিলেন যারা পুলিসের বিনানুমতিতে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না?
শ্যামলকুমার, সুজিতকুমার, সুভদ্রা দেবী আর আপনি ও দোলগোবিন্দবাবু।
রাধারমণ পাল যেন কেমন ফ্যালফ্যাল করে বোবা অসহায় দৃষ্টিতে কয়েকটা মুহূর্ত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর কিছুক্ষণ বাদে শুকনো গলায় প্রশ্ন করেন জিভটা দিয়ে ঠোঁট চেটে, কেন, আমাদের কি আপনি সন্দেহ করেন?
আপনাদের সকলের উপরই যে পুলিসের সন্দেহ পড়েছে তা নয়—
তবে?
বুঝতেই পারছেন আপনারা যাঁরা যাঁরা মৃত হরিদাস সামন্তর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এ হত্যারহস্যের মীমাংসায় একটা পোঁছতে হলে আপনাদের প্রত্যেকেরই, যাঁদের নাম করলাম আমাদের প্রয়োজন।
কিন্তু—ইতস্তত করলেন রাধারমণ পাল।
বলুন, থামলেন কেন?
সতিই কি আপনারা মনে করেন হরিদাস সামন্তকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে?
পুলিসের ধারণা আপাতত তাই, তবে ময়নাতদন্তে যদি অন্য কিছু প্রকাশ পায়।
কিন্তু আমরা আমাদের এককালের একজন সহকর্মীকে হত্যা করতে যাবই বা কেন?
সেটা জানতে পারলে তো সব কিছুর মীমাংসা হয়েই যেত পাল মশাই। যাক, যা বললাম, সেই মত সকলকে বলে দিন। আর পরশু বা তরশু বিকেলের দিকে আপনাদের চিৎপুরের অফিসে যাব, ওদের সকলকে উপস্থিত থাকতে বলবেন।