মণীশ চক্রবর্তী প্রথমে তার প্রচলিত ভঙ্গীতে প্রশ্ন শুরু করলেন, আপনিই সুভদ্রা দেবী?
জলে ভরা চোখ দুটি তুলে নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে সুভদ্রা সম্মতি জানাল।
অনেক দিন এ দলে আছেন?
হ্যাঁ।
সুজিতবাবু বলছিলেন আপনাকে তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি সময়ে একবার নাকি এ ঘরে আসতে দেখেছিলেন।
সুজিতবাবু ঠিকই দেখেছিলেন। এসেছিলাম।
কেন?
সামন্ত মশাই আমাকে ডেকেছিলেন।
কিরীটী নিঃশব্দে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুভদ্রার সারা দেহ।
মণীশ চক্রবর্তী আবার প্রশ্ন করেন, কেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
বলেছিলাম বর্ধমানে যাব, তাই বারণ করলেন যেন না যাই।
বর্ধমানে কেন যেতে চেয়েছিলেন?
মাসীর খুব অসুখ।
তারপর কতক্ষণ ছিলেন?
মিনিট দশেক।
ঐ সময় কিরীটীর দিকে তাকিয়ে মণীশ চক্রবর্তী বললেন, কিছু জিজ্ঞাসা করবেন ওঁকে?
কিরীটী সুভদ্রার দিকে তাকিয়ে বললে, সুভদ্রা দেবী, শুনলাম সুজিতবাবুই আপনাকে একদিন এই যাত্রাদলে এনেছিলেন?
হ্যাঁ।
সুজিতবাবুর সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?
আমি এই যাত্রার দলে আসার আগে মধ্যে মধ্যে অ্যামেচার ক্লাবে প্লে করতাম। সুজিতবাবু একবার আমার প্লে দেখে আলাপ করেন। তারপর আমি যাত্রার দলে যোগ দিতে চাই কিনা জিজ্ঞাসা করলে আমি বলি, হ্যাঁ। তখন উনি নিয়ে আসেন আমাকে। সেই থেকেই আমাদের পরিচয়।
তার আগে পরিচয় ছিল না? ওঁকে জানতেনও না?
না।
আপনার মা বাবা ভাই বোন নেই?
না।
ছোটবেলায় মা-বাবা মারা যায়, তারপর মাসীর কাছেই আমি মানুষ।
বর্ধমান থেকে কলকাতায় যাতায়াত করতেন?
তা কেন!
তবে?
আমি পনের বছর বয়সেই কলকাতায় চলে আসি আমার স্বামীর সঙ্গে।
আপনার বিয়ে হয়েছিল?
হয়েছিল।
স্বামী এখন কোথায়?
কোথায় চলে গিয়েছে কেউ জানে না।
কতদিন আগে?
বছর দশেক আগে, বুঝতেই পারছেন। তারপর লেখাপড়া শিখিনি, বাঁচতে তো হবে, কাজেই এখানে-ওখানে অভিনয় শুরু করলাম।
ইদানীং হরিদাস সামন্তর সঙ্গেই বোধ হয় ঘর করছিলেন?
সুভদ্রা মাথা নীচু করল।
সুভদ্রা দেবী!
বলুন?
আপনি যখন তৃতীয় অঙ্কের মাঝামাঝি সময় এ ঘরে আসেন, সামন্ত মশাই তখন কি করছিলেন মনে আছে আপনার?
চুপচাপ বসেছিলেন।
তিনি মদ্যপান করছিলেন, না?
ঠিক মনে নেই। বোধ হয় করছিলেন।
তাহলে ঘরে বোতল একটা নিশ্চয়ই থাকত, বোধ হয় তিনি মদ্যপান করছিলেন না! মনে করে বলুন তো?
কি বললেন?
বলছি তিনি তখন মদ্যপান করছিলেন না বোধ হয়!
তা হবে। আমি ঠিক লক্ষ্য করিনি।
কোন গ্লাস ঘরে ছিল?
গ্লাস!
হ্যাঁ, ঐ কাচের গ্লাসটা–কিরীটী অদূরে টুলের উপরে রক্ষিত শূন্য কাচের গ্লাসটা দেখাল।
দেখিনি।
হুঁ। আচ্ছা, ইদানীং আপনার সঙ্গে তাঁর মন-কষাকষি চলছিল, তাই না?
অত্যন্ত সন্দেহ বাতিক ছিল লোকটির—
স্বাভাবিক। নিম্নকণ্ঠে কিরীটী কথাটা উচ্চারণ করল।
কিছু বললেন?
না। আচ্ছা, কে আপনাদের মধ্যে সামন্ত মশাইকে বিষ দিয়ে হত্যা করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
বিষ!
হ্যাঁ, তীব্র কোন বিষপ্রয়োগেই ওঁর মৃত্যু হয়েছে।
না না, ওঁর হার্টের ব্যামো ছিল, ব্লাড-প্রেসারও ছিল।
তা হয়তো ছিল, তবে তাঁর মৃত্যু বিষের ক্রিয়াতেই হয়েছে বলেই আমাদের ধারণা।
কিন্তু কে তাঁকে বিষ দেবে? কেউ তো তাঁর শত্রু এখানে ছিল না?
কার মনে কি আছে আপনি জানবেন কি করে? তারপরই হঠাৎ কিরীটী বললে, আপনার ডান হাতের কবজির কাছে রক্তের দাগ কিসের দেখি। দেখি হাতটা আপনার?
রক্তের দাগকই! না তো, ও কিছু না। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, সন্ধ্যার সময় সাজঘরের টিনের পার্টিশনের একটা পেরেকে হাতটা কেটে গিয়েছিল কবজির কাছে।
অভিনয়ের সময় দেখেছিলাম, আপনার দুহাতে কাচের আয়নার চুমকি বসানো দুটি চুড়ি। চুড়ি দুটো বুঝি খুলে রেখেছেন?
হ্যাঁ। সাজঘরে বাক্সর মধ্যে।
নিয়ে আসতে পারেন চুড়ি দুটো?
সুভদ্রা কেমন যেন এবারে একটু থতমত খেয়ে যায়। চুপ করে থাকে। কেমন যেন একটু মনে হয় ইতস্তত ভাব একটা।
কই, যান? নিয়ে আসুন চুড়ি দুটো?
সুভদ্রা বেরুচ্ছিল, কিন্তু কিরীটী তাকে আবার কি ভেবে বাধা দিল, না, আপনি না। মণীশ চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে বলল, মিঃ চক্রবর্তী, বাইরে কাউকে বলুন তো, সুভদ্রা দেবীর সাজঘর থেকে চুড়ি দুটো নিয়ে আসতে।
মণীশ চক্রবর্তী বের হয়ে গেলেন।
ঘরে এবারে একা সুভদ্রা।
সুভদ্রা যেন বেশ একটু বিব্রতই বোধ করে, অথচ মুখে সেটা প্রকাশ না করলেও কিরীটীর বুঝতে কিন্তু অসুবিধা হয় না।
কিরীটী সুভদ্রার মুখের দিকে তাকাল।
সুভদ্রা দেবী!
অ্যাঁ! আমায় কিছু বলছিলেন?
সুভদ্রা দেবী, আমার নামটা বোধ হয় আপনি জানেন না—
সামন্ত মশাই যে বলছিলেন, ধূর্জটি রায় আপনার নাম!
নামটা আপনার মনে আছে দেখছি। কিন্তু ওটা তো আমার আসল নাম নয়।
তবে?
ওটা আমার অন্য একটি নাম, বিশেষ করে নামের আড়ালে যখন আমি আমাকে কিছুটা গোপন করতে চাই। বলতে পারেন ছদ্মনাম।
ছদ্মনাম!
হ্যাঁ।
সুভদ্রা তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ—কিরীটী রায় নামটা কখনও শুনেছেন?
কিরীটী রায়! আপনি কি তবে সেই বিখ্যাত রহস্যানুসন্ধানী—একটা ঢোঁক গিলে কেমন যেন শুকনো গলায় থেমে থেমে কথাগুলো টেনে টেনে উচ্চারণ করল সুভদ্রা।
হ্যাঁ, আমিই সেই।
তবে আপনি–
না। সামন্ত মশাইয়ের বন্ধু আমি কোনদিনও ছিলাম না—তাঁর সঙ্গে পরিচয় মাত্র আমার কয়েকদিন আগে। এবং আরও বোধ হয় আপনার একটা কথা জানা দরকার, তিনি মৃত্যু-আশঙ্কা করছিলেন বলেই আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন।