তা তো হবারই কথা। তা ড্রিঙ্ক-ট্রিঙ্ক করেন না?
একসময় করতাম, এখন পেলে করি, না পেলে করি না, বুঝলেন না—মানে ঐ আর কি, পরের পয়সায় বলতে বলতে সুজিত পানের রসে রাঙানো লালচে দাঁতগুলো বের করে হাসল।
কিরীটীর যেন সে হাসি দেখে গা ঘিনঘিন করে।
আর সিগারেট?
ধূমপান?
পানের সঙ্গে ওটা ঠিক জমে না, বুঝলেন না!
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তবে মিথ্যে বলব না, খাই। মানে ধূমপানে অভ্যস্ত আমি।
কি ব্র্যান্ড খান?
যা পাই।
আপনার পকেটে সিগারেটের প্যাকেট আছে?
হ্যাঁ। সুজিত পকেটে হাত চালিয়ে একটা দোমড়ানো সিগারেটের প্যাকেট বের করল। অর্ধেক খালি বাক্সটার।
কিরীটী সিগারেটের প্যাকেটটা দেখে ফিরিয়ে দিল।
সুজিতবাবু, আচ্ছা হরিদাস সামন্ত পান খেতেন?
সুজিত লালচে দাঁতগুলো বের করে বললে, হ্যাঁ। তবে পাতা পান নয়, বোতল পান করতেন, মাত্রাধিক্যেই।
আর সিগারেট?
হ্যাঁ, তাও খেতেন।
কি ব্র্যান্ড খেতেন বলতে পারেন?
চারমিনার।
আচ্ছা সুজিতবাবু?
আজ্ঞে!
শ্যামলকুমার লোকটি কেমন!
ছুঁচো।
কি রকম?
ছুঁচো যেমন সর্বদা ছোঁকছোঁক করে, তারও অভ্যাসটি তেমনি।
কি রকম? কিসের জন্য ছোঁকছোঁক করতেন?
বুঝলেন না?
না।
স্ত্রীলোক-বুঝলেন, স্ত্রীলোক!
হুঁ। তা এ দলে কোন মেয়ের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল নাকি?
কেন—হরিদাস সামন্ত মশাইয়ের বন্ধু আপনি, শোনেননি তার কাছে কিছু?
না।
তার স্ত্রীলোকটির উপরেই যে নজর ছিল শ্যামলকুমারের!
তাই নাকি? একটু থেমে কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা সুজিতবাবু, হরিদাস সামন্তর সঙ্গে শ্যামলকুমারের কি রকম সদ্ভাব ছিল বলুন তো?
সাপে-নেউলের সম্পর্ক যেমন তেমনি ধরনের সদ্ভাব ছিল বলতে পারেন।
কেন বলুন তো?
ঐ যে একটু আগেই বললাম-বুঝলেন না!
মানে?
মানে সামন্ত মশাইয়ের মেয়েমানুষ ছিল সুভদ্রা, শ্যামলকুমার এসে সেই মেয়েমানুষটিকে হাতিয়ে নিয়েছিল। তার ফলে যা হবার তাই হয়েছিল।
হুঁ। আচ্ছা আর একটা কথা—
কি, বলুন?
আগে তো, মানে শ্যামলকুমার আসার আগে এ দলে বোধ হয় হিরোর পার্ট আপনিই করতেন, তাই না?
করতাম, আর এখনও করতে পারি। শুধু তো মাকাল ফলের মত চেহারাই হলে হয় না মশাই, অভিনয়-বস্তুটি হচ্ছে একটা আর্ট, বুঝলেন, গড়গড় করে তোতাপাখীর মত খানিকটা শেখানো বুলি আওড়ে গেলেই সেটা অভিনয়—acting হয় না। শ্যামল অভিনয়ের কি বোকে? কিন্তু পাল মশাইয়ের কি সে খেয়াল আছে?
আপনার অভিনয় কিন্তু আজ আমার সত্যি চমৎকার লেগেছে।
লেগেছে তো? লাগতেই হবে। আপনাদের মত অভিনয়রসিক বলেই বুঝেছেন?
আচ্ছা, হরিদাস সামন্ত কেমন অভিনয় করতেন?
এককালে ভাল অভিনয়ই করত। কিন্তু ঐ যে মহা দুটি ব্যাধি—মদ আর স্ত্রীলোক, এতেই ওর সর্বনাশ হল।
আপনি বলতে চান তাহলে মেয়েমানুষের জন্যই ওর প্রাণটা গেল?
নির্ঘাত।
মেয়েমানুষটি তাহলে আপনার মনে হয়—
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের সুভদ্রা দেবী। সাক্ষাৎ কালনাগিনী, বুঝলেন—বিষকন্যা!
০৭. বিষকন্যা কেন বলছেন
বিষকন্যা কেন বলছেন?
যে কন্যার সংস্পর্শই বিষ, সে-ই তো প্রাণঘাতিনী বিষকন্যা।
তা বটে। তারপর একটু থেমে কিরীটী বললে, সুজিতবাবু, এবারে সত্যি করে বলুন তো, আজ অভিনয় শুরু হবার পর একবারও কি এ ঘরে আপনি আসেননি?
না।
ঠিক বলছেন?
নিশ্চয়ই।
মনে করে আবার ভাল করে ভেবে বলুন?
ভাবাভাবির বা মনে করবার কি আছে? আসিনি।
কিন্তু আমি যদি বলি—
কি?
আজ অভিনয় শুরুর পরে এ ঘরে আপনি এসেছিলেন!
না।
সুজিতবাবু, আমার হাতে প্রমাণ আছে যে আপনি এ ঘরে এসেছিলেন।
প্রমাণ? এ কি বলছেন মশাই?
কিরীটীর মনে হল গলাটা যেন কেমন বসে গেছে হঠাৎ সুজিতকুমারের।
গলার স্বরটা যেন ঠিক স্পষ্ট নয়।
কিরীটী বুঝতে পারে তার নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যভেদ করেছে।
অস্বীকার করে কোন লাভ নেই। বলুন, কেন এসেছিলেন?
আমি আসিনি।
আপনার জামার পকেটে ওটা কি উঁচু হয়ে আছে? দেখি বের করুন তো?
ওটা একটা হাফ পাই বোতল।
বোতলটা বের করুন।
সুজিত পকেট থেকে একটা কালো চ্যাপ্টা মত হাফ পাই বিলিতি মদের বোতল বের করল।
কি আছে ওতে?
হুইসকি।
দেশী না বিলিতি?
দেশী।
বোতলটা তো দেখছি অর্ধেকের বেশী খালি। এটা কি পরস্মৈপদী নাকি?
মানে?
কেউ কি দিয়েছে?
হ্যাঁ।
কে দিল?
পাল মশাই। তারপরই একটু থেমে বলল, অভিনয়ের রাত্রে বিশেষ করে অভিনয়ের সময় মধ্যে মধ্যে না পান করলে আমি অভিনয় করতে পারি না। তাই পাল মশাই অভিনয়ের রাত্রে একটা পাইন্ট বোতল আমাকে দিয়ে থাকেন।
কিরীটী ক্ষণকাল অতঃপর সুজিতকুমারের দিকে চেয়ে রইল।
আমি এবারে যেতে পারি?
হ্যাঁ। কিন্তু বোতলটা আমার চাই, দিন।
বোতলটা।
হ্যাঁ, দিন।
নিন।
সুজিত বোতলটা কিরীটীর হাতে তুলে দিল। কিরীটী বোতলটা চোখের সামনে তুলে ধরে দেখল, তারপর সেটা সামনের টেবিলের উপরে রেখে দিল।
আচ্ছা, এবারে আপনি যেতে পারেন।
সুজিতকুমার ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মণীশ চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করলেন, ও কি সত্যিই আজ রাত্রে একবার এ ঘরে এসেছিল বলে আপনার মনে হয় মিঃ রায়?
মনে হয় নয়, এসেছিল। কিন্তু একটা ব্যাপার কেমন যেন খটকা লাগছে।
কি বলুন তো?
কিছু না। সুভদ্রা দেবীকে এবারে ডাকান তো!
এখুনি ডাকছি।
মণীশ চক্রবর্তী ঘরের দরজার বাইরে গিয়ে সুভদ্রাকে ঐ ঘরে পাঠিয়ে দেবার জন্য বললেন।
একটু পরে সুভদ্রা এল। কেঁদে কেঁদে তার দুচোখের পাতা ফুলে উঠেছে। চোখের পাতায় তখনও জল বোঝা যায়। সুভদ্রা ইতিমধ্যেই তার অভিনয়ের সাজপোশাক ছেড়ে ফেলেছে। পরনে সাধারণ একটি লাল রংয়ের চওড়াপাড় তাঁতের শাড়ি। কিরীটী লক্ষ্য করল মুখের প্রসাধনও তুলে ফেলেছে সুভদ্রা ইতিমধ্যেই।