হ্যাঁ বলেছেন, তা কেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন তা বলেননি।
সামন্তদার মনে ইদানীং একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল–
জানি। আপনার ইদানীং সুভদ্রা দেবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার জন্য। তিনি আদপেই ব্যাপারটা সহ্য করতে পারছিলেন না, তাই না?
হ্যাঁ।
আপনি—আপনি কি করে জানলেন? শ্যামলকুমার প্রশ্ন করে।
জানি। তারপর একটু থেমে—এবার বলুন শ্যামলবাবু, সুভদ্রা দেবীর সঙ্গে সত্যিই কি আপনার–
হ্যাঁ, আমি তাকে ভালবাসি।
আর সুভদ্রা দেবী?
সেও আমাকে ভালবাসে।
হুঁ। তা কি কথা হয়েছিল আপনাদের মধ্যে?
ঘরে এসে ঢুকতেই আজ উনি আমাকে বললেন, শেষবারের মত তোমাকে বলছি শ্যামল, আমাদের ভিতর থেকে তুমি সরে দাঁড়াও, নচেৎ এমন শিক্ষা তোমাকে পেতে হবে যে জীবন দিয়ে তোমাকে তা শোধ করতে হবে।
আপনি কি জবাব দিলেন?
আমি বলেছিলাম, এই জন্যই যদি ডেকেছেন জানলে আসতাম না—যা বলবার আপনি সুভদ্রাকে বলবেন। সে যদি আমাকে না চায় তো আমি নিশ্চয়ই সরে দাঁড়াব।
আর কোন কথা হয়নি?
না।
তারপর আর এ ঘরে আপনি আসেননি?
না।
আচ্ছা, এ ব্যাপারে আপনার দলের কাউকে সন্দেহ হয়?
না।
আর কারও সঙ্গে দলের মধ্যে হরিদাসবাবুর কোন মনোমালিন্য বা ঝগড়াঝাঁটি কখনও হয়েছে বলে জানেন?
সুজিতের সঙ্গে তো ওঁর খিটিমিটি লেগেই ছিল।
তাই নাকি? কেন?
তা জানি না, তবে—
তবে?
এককালে শুনেছি ওর অবস্থা নাকি খুব ভাল ছিল, রেস খেলে ও মদ্যপান করে সব খুইয়েছে। সুজিতবাবু! তাছাড়া–
তাছাড়া?
শুনেছি সুভদ্রাকে ও-ই দলে এনেছিল। একসময় সুভদ্রার সঙ্গে ওর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতাও ছিল। সামন্তদা আসার পর থেকেই সামন্তদার সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিল সুভদ্রা।
আচ্ছা, সুভদ্রাকে আপনার কি রকম মনে হয়?
খুব ভাল মেয়ে।
আজ পালা শেষ হবার পর রাত্রে সুভদ্রা বলছিল বর্ধমান যাবে। আপনি জানেন সেকথা?
হ্যাঁ, আমাকে ও বলেছিল।
আপনারও সঙ্গে যাবার কথা ছিল কি?
না।
কেন যাবে বলেছিল সুভদ্রা বর্ধমানে, জানেন কি?
তার এক মাসী বর্ধমানে নাকি থাকে, তার অসুখ, তাকেই বলেছিল দেখতে যাবে বর্ধমানে।
আপনাকে সঙ্গে যেতে বলেনি?
বলেছিল, কিন্তু আমি বলেছিলাম যাব না।
ঠিক আছে, আপনি যান, সুজিতবাবুকে একবার পাঠিয়ে দিন।
শ্যামলকুমার চলে গেল।
মণীশ চক্রবর্তী কিরীটীর দিকে তাকালেন, ছেলেটাকে কি রকম মনে হল কিরীটীবাবু?
আপনার কি মনে হল?
গভীর জলের মাছ। তা বাছাধন জানেন না যে আমারও এ লাইনে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। তাছাড়া ও সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। এ আপনাকে আমি বলে রাখছি, ঐ—ঐ হচ্ছে—
মণীশ চক্রবর্তীর কথা শেষ হল না। সুজিতকুমার এসে ঘরে ঢুকল।
সুজিতকে প্রথমে মণীশ চক্রবর্তী প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।
কিরীটী তখন ঘরের চারিদিকে আবার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ঘরটা ভাল করে দেখা হয়নি। হঠাৎ কিরীটীর নজরে পড়ল, দরজার গোড়ায় একটা সিগারেটের পোড়া টুকরো। কিরীটী গিয়ে নীচু হয়ে সিগারেটের টুকরোটা তুলে নিতে গিয়ে নজরে পড়ল যে চেয়ারের উপরে হরিদাস সামন্তর মৃতদেহটা উপবিষ্ট, তার নীচে কি একটা পড়ে আছে, চকচক করছে।
মণীশ চক্রবর্তী তখন সুজিতকে নিয়ে ব্যস্ত, সেদিকে নজর দেবার মত অবকাশ ও মন কোনটাই ছিল না। সে তাকালও না কিরীটীর দিকে।
কিরীটী নীচু হয়ে চকচকে বস্তুটি তুলে নিয়ে দেখল একটা শৌখিন গালার চুড়ির ভগ্নাংশ, আয়না কাচের চুমকি বসানো। সেই আয়না কাচের উপরেই আলো পড়ে ঝিলিক দিচ্ছিল।
সিগারেটের শেষাংশটাও পরীক্ষা করল।
চারমিনার সিগারেট এবং সেই সিগারেটটা যে খাচ্ছিল সে নিশ্চয়ই পান খেয়েছিল, কারণ শেষাংশে পানের ছোপ শুকিয়ে আছে।
দুটো বস্তুই কিরীটী পকেটে রেখে দিল সযত্নে।
মিঃ রায়—
মণীশ চক্রবর্তীর ডাকে কিরীটী ওর দিকে তাকাল।
ওঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন নাকি?
দু-একটা প্রশ্ন করব। সুজিতবাবু, আপনি বলেছিলেন তৃতীয় অঙ্ক শুরু হবার পর আপনি একবার শ্যামলকুমারকে এ ঘরে আসতে দেখেছিলেন!
হ্যাঁ।
তখন রাত কটা হবে বলে আপনার মনে হয়?
কত আর হবে, রাত সোয়া দশটা কি সাড়ে দশটা।
শ্যামলবাবু এ ঘরে কতক্ষণ ছিলেন জানেন?
তা মিনিট পনের-কুড়ি হতে পারে।
বুঝলেন কি করে? আপনি বুঝি ততক্ষণ দরজার বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন?
তা কেন! আমি—আমি চলে গিয়েছিলাম।
তাহলে জানলেন কি করে শ্যামলবাবু এ ঘরে মিনিট পনের-কুড়িছিলেন?
মানে মিনিট পনের-কুড়ি বাদে এদিকে আসছিলাম, তখন তাকে বেরুতে দেখেছিলাম এই ঘর থেকে।
হুঁ। তাদের পরস্পরের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছিল বলতে পারেন?
তা কেমন করে বলব! আমি তো আর ঘরে যাইনি।
তা ঠিক। তবে অনুমান তো করতে পারেন?
অনুমান!
হ্যাঁ, অনুমান।
না। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে—
কি?
দরজার বাইরে দাঁড়িয়েও তো তাদের দু-একটা কথা আপনার কানে আসতে পারে?
না মশাই, তাছাড়া কোথাও আড়ি পাতা আমার অভ্যাস নেই।
হঠাৎ কিরীটী বলে, আপনি খুব পান খান সুজিতবাবু মনে হচ্ছে?
সুজিত একমুখ পান নিয়ে চিবোচ্ছিল। দোক্তাসিক্ত লালচে এবড়োখেবড়ো দুপাটি দাঁত বার করে সুজিত বললে, হ্যাঁ, সর্বক্ষণ পান-দোক্তা না হলে আমার চলে না।
আর কোন কিছুর প্রতি আসক্তি নেই আপনার সুজিতবাবু?
আসক্তি তো অনেক কিছুর উপরেই ছিল, কিন্তু একে একে সবই ছেড়েছি।
তাই নাকি!
হ্যাঁ, বড় বদ অভ্যাস। আর বদ অভ্যাসের উপর একবার আসক্তি জমলে তা সে যেমনই হোক না কেন ছাড়তে বড় কষ্ট হয়।