সুকান্ত মল্লিক আমার বিশেষ বন্ধু।
আ–আপনার বন্ধু আমাদের বড়সাহেব, তা এ কথাটা এতক্ষণ বলেননি কেন?
আপনার কাছে কি সেকথা বলতে পারি?
পারবেন না কেন? হাজারবার পারেন। তা আপনি দাঁড়িয়ে কেন-বসুন। মণীশ চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বর ও চেহারা যেন সম্পূর্ণ পাল্টে যায় মুহূর্তেই, ভদ্রলোক যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।
কুণ্ডু মশাই, ও কুণ্ডু মশাই? চেঁচিয়ে ওঠেন মণীশ চক্রবর্তী।
গৃহকর্তা রমণীমোহন কুণ্ডু হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন, কিছু বলছিলেন স্যার?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওঁর বসবার জন্য একটা চেয়ার এনে দিন।
এখুনি এনে দিচ্ছি স্যার।
হ্যাঁ, তারপর পাল মশাইকে এ ঘরে পাঠিয়ে দিন।
রমণীমোহন কুণ্ডু যেমন হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলেন, তেমনি আবার হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে।
মিঃ চক্রবর্তী?
বলুন।
আমি যদি আপনার জবানবন্দি নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দু-একটা প্রশ্ন করি?
একশোবার করবেন। হাজারবার করবেন।
কিরীটী মনে মনে হাসল, চাকরির কি মহিমা! আই.জি. সুকান্ত মল্লিকের সঙ্গে আলাপ আছে শুনেই মণীশ চক্রবর্তী একেবারে যেন বিনয়াবনত, বশংবদ।
.
আরও মিনিট দশেক পরে।
প্রথম জবানবন্দি নেওয়া হচ্ছিল দলের অধিকারী রাধারমণ পালের। মণীশ চক্রবর্তী প্রশ্নাদি করবার পর কিরীটী মুখ খুলল।
পাল মশাই, শুনেছি হরিদাস সামন্ত একদিন আপনার পার্টনার ছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ।
তা পার্টনারশিপ ছেড়ে দিলেন কেন?
আপনি তো তার বন্ধুজন ছিলেন, জানেন না তার চরিত্রের কথা?
দীর্ঘদিন দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না—
ওর দুটি বিশেষ ব্যাধি ছিল।
ব্যাধি?
হ্যাঁ। একটি মদ্যপান, আর—
আর?
স্ত্রীলোক সম্পর্কে ওর একটা বিশ্রী দুর্বলতা, তাই তো–
কি?
একের নম্বরের যাকে বলে লম্পট। ঐ দুটি রোগই ওর সর্বনাশ করেছিল। নচেৎ অভিনয়-প্রতিভা যেমন ছিল লোকটার তেমনি অন্য দিক দিয়ে সৎও ছিল। কিন্তু ঐ যে মদ্যপান ও স্ত্রীলোক-ব্যাধি, সর্বগুণ হরে নিয়েছিল। নইলে মনে করুন কিনা, সুভদ্রা মেয়েটা তো ওর মেয়ের বয়সী, না কি–
বাধা দিল কিরীটী, থাক ওকথা। আচ্ছা সবার আগে আপনিই তাহলে সামন্ত মশাইকে মৃত আবিষ্কার করেন?
আজ্ঞে।
এ ঘরে কি করতে এসেছিলেন, উনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন।?
না।
তবে?
কিছু টাকা চেয়েছিলেন, সেই টাকা দিতে এসেই তো—
আপনি ঘরে ঢুকে দেখলেন, ঐভাবে বসে আছেন?
হ্যাঁ, প্রথমটা তো বুঝতেই পারিনি, তারপর—
পাল মশাই?
আজ্ঞে?
নাটকের শেষ দৃশ্যে ছিল ভৃত্য গিয়ে আসরে খবর দেবে কর্তবাবুর মৃত্যু হয়েছে, তাই না?
হ্যাঁ।
ভৃত্য কে সেজেছিল?
ভৃত্য যে সাজত সে অনুপস্থিত আজ। তাই দোলগোবিন্দবাবুকে বলেছিলাম। দ্বিতীয় অঙ্কের পর তার তো পার্ট ছিল না, তাই বলেছিলাম সে-ই যেন ভৃত্যের মেকআপ নিয়ে আসরে গিয়ে কথাগুলো বলে আসে।
পাল মশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, কিন্তু তিনি তো যাননি।
যাননি! সে কি! দোলগোবিন্দবাবু যাননি?
না। ফলে যা হবার তাই হয়েছিল। নাটকটি শেষ হতে পারেনি। কিরীটী অতঃপর দৃশ্যের শেষ ব্যাপারটা খুলে বললে।
দাঁড়ান তো, দোলগোবিন্দবাবুকে ডাকি।
ব্যস্ত হবেন না পাল মশাই, পরেও কথাটা জিজ্ঞাসা করলে চলবে।
কেন গেল না—
এবার আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন তো?
কি প্রশ্ন?
মণীশ চক্রবর্তী খিঁচিয়ে ওঠেন, যা জানতে চান উনি তার জবাব দিন।
আজ্ঞে?
পাল মশাই? কিরীটী ডাকল, এই ব্যাপারে আপনার দলের কাউকে কি সন্দেহ হয়?
সন্দেহ? সন্দেহ কাকে করব? না না, আমার দলের মধ্যে কেউ এমন কাজ করতে পারেই না। তাছাড়া সামন্ত মশাইকে দলের সকলেই শ্রদ্ধা করত, ভালবাসত, ভক্তি করত।
মণীশ চক্রবর্তী ঐ সময় প্রশ্ন করলেন, শ্যামলকুমার? শ্যা
মলকুমার!
হ্যাঁ, তার সঙ্গে তো শুনলাম সুভদ্রা বলে আপনার দলের মেয়েটিকে নিয়ে সামন্তর সঙ্গে রীতিমত একটা রেষারেষি চলছিল ইদানীং।
না না, রেষারেষি আবার কি! সামন্ত মশাইয়ের অবিশ্যি মনে তাই হয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, সুভদ্রা সেরকম মেয়ে নয়, ওটা সামন্ত মশাইয়ের মনের ভুল। তাছাড়া শ্যামল ছেলেটি যেমন ভদ্র তেমনি ধীরস্থির, এসব খুনখারাপির মধ্যে সে থাকতেই পারে না।
ঠিক আছে। মণীশ চক্রবর্তী বললেন।
কিন্তু পাল মশাই, আমাদের ধারণা, কিরীটী বললে, আপনাদের দলেরই কেউ সামন্ত মশাইকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছে।
এ আপনি কি বলছেন? না না, হয়তো—
কি?
সামন্ত মশাই আত্মহত্যা করেছেন।
আত্মহত্যা!
কেন, পারেন না?
তা পারেন–তবে বোধ হয় তা করেননি। ঠিক আছে, আপনি দয়া করে শ্যামলকুমারকে এখন একবার পাঠিয়ে দিন।
রাধারমণ পাল ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। একটু পরে শ্যামলকুমার এসে ঘরে ঢুকল।
মণীশ চক্রবর্তীই প্রথমে তাকে নানাবিধ প্রশ্ন শুরু করলেন, একটার পর একটা। অবশেষে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে একসময় বললেন, ওঁকে জিজ্ঞাসা করবেন নাকি কিছু? জিজ্ঞাসা করবার আর কিছু আছে?
কিরীটী তাকাল শ্যামলকুমারের দিকে।
শ্যামলকুমার যেন কেমন একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে।
হাতের আঙুলগুলো নিয়ে কেবলই নাড়াচাড়া করছে।
শ্যামলবাবু!
আজ্ঞে?
সুজিতবাবু বলছিলেন তখন—
কি—কি বলছিলেন সুজিতবাবু?
আজকের তৃতীয় অঙ্কের শুরু হবার পর একবার আপনি এই ঘরে এসেছিলেন।
হ্যাঁ, এসেছিলাম। সামন্তদা ডেকে পাঠিয়েছিলেন, সে কথা তো তখুনি আপনাকে বললাম।