রাধারমণ পাল তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, দোলগোবিন্দবাবু, উনি সামন্ত মশাইয়ের বন্ধু।
বন্ধু তো হয়েছে কি?
ঠিক সেই সময় স্থানীয় থানার অফিসার-ইন-চার্জ মণীশ চক্রবর্তী হন্তদন্ত হয়ে এসে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর পিছনে পিছনে রমণীমোহন কুণ্ডু।
মণীশ চক্রবর্তীর বয়স চল্লিশের কিছু ঊর্ধ্বে বলেই মনে হয়। রীতিমত পালোয়ানের মত চেহারা। পাকানো একজোড়া গোঁফ। থুতনিতে নূর দাড়ি। পরনে পুসির ইউনিফর্ম।
কোথায় কোথায় ডেড় বডি?
ঐ যে—বললে কিরীটী।
মণীশ চক্রবর্তী এগিয়ে গিয়ে ডেড় বডির সামনে দাঁড়ালেন। নানা ভঙ্গিতে দেখলেন দূর থেকে, সামনে থেকে, কখনও ঝুঁকে পড়ে, কখনও সামান্য একটু হেলে দাঁড়িয়ে।
কখন মারা গিয়েছে? I mean কখন ব্যাপারটা আপনারা জানতে পেরেছেন?
কথাগুলো বলে পর্যায়ক্রমে মণীশ চক্রবর্তী ঘরের মধ্যে উপস্থিত দণ্ডায়মান সকলের দিকেই তাকালেন।
সবাই চুপ, কারও মুখে কোন কথা নেই।
কি হল? সবাই আপনারা ডে অ্যান্ড ডাম্ব স্কুলের ছাত্র হয়ে গেলেন নাকি? শুনতে পাচ্ছেন না কথাটা আমার, না জবাব দিতে পারছেন না?
তবু কারও মুখে কোন শব্দ নেই। পূর্ববৎ সবাই যেন বোবা—সবাই পুতুলের মত দাঁড়িয়ে।
ঐভাবে ধমক দিয়ে কি ওদের কারও মুখে কোন কথা বের করতে পারবেন অফিসার? এক এক করে আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞাসা করুন। কিরীটী মৃদু গলায় বললে, দেখছেন তো ঘটনার আকস্মিকতায় ওঁরা সব ঘাবড়ে গিয়েছেন।
কিরীটীর দিকে তাকালেন মণীশ চক্রবর্তী। বার কয়েক যেন তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে কিরীটীকে জরীপ করলেন। তারপর বললেন, আপনি?
রাধারমণ পাল বললেন, সামন্ত মশাইয়ের উনি বন্ধু।
বন্ধু?
আজ্ঞে।
তা উনিও কি যাত্রাদলের! কিরীটীর বেশভূষা লক্ষ্য করেই মণীশ চক্রবর্তী কথাটা বললেন।
না–উনি এসেছিলেন ওঁর বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তারপর পালা শুনছিলেন।
অফিসার, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। ঐ সময় কিরীটী বললে।
কি কথা?
আগে সকলকে ঘর থেকে একটু বেরুতে বলুন, তারপর বলছি।
মণীশ চক্রবর্তী জ কুঁচকে যেন কি ভাবলেন মুহূর্তকাল, তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা একটু বাইরে যান।
সকলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
ঘর থেকে বের হয়ে গেল সবাই। ঘর খালি হয়ে গেল।
কি বলছিলেন বলুন?
কিছু বলবার আগে বলতে চাই, আজকের ব্যাপারটার একটা উপক্রমণিকা আছে মিঃ চক্রবর্তী।
উপক্রমণিকা! সে আবার কি?
কিরীটী তখন তাঁর কাছে হরিদাস সামন্তর যাওয়া থেকে আজকের সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলে গেল, তারপর বললে, মানুষগুলোকে স্বচক্ষে দেখবার জন্য ও বোঝবার জন্যই আমি আজ এখানে এসেছিলাম। একবারও ভাবতে পারিনি সত্যিই এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটবে।
কিন্তু এখনও আপনার আসল পরিচয়টা তো পেলাম না?
কিরীটী মৃদু গলায় নিজের নামটা উচ্চারণ করল।
মণীশ চক্রবর্তী যেন আর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীকে জরীপ করলেন।
তারপর বললেন, ও, আপনিই সেই বেসরকারী গোয়েন্দা কিরীটী রায়! হ্যাঁ, নামটা আপনার শুনেছি দু-একবার।
আজ্ঞে তবে গোয়েন্দা ঠিক নয়—
তবে? রহস্যের সন্ধান করে আমি বিশেষ আনন্দ পাই। বলতে পারেন ওটা আমার একটা নেশা।
নেশাটা দেখছি বড় জব্বর নেশা! তা আপনি এ ব্যাপারে কি মনে করেন?
মণীশ চক্রবর্তীর কথা বলার ভঙ্গি ও কথাগুলোর মধ্যে স্পষ্টই যেন একটা তাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ পায়।
কিরীটী সেটা বুঝতে পেরেই মৃদু হেসে বলে, আমি আর কি বলব মিঃ চক্রবর্তী? আপনিই যখন এসে পড়েছেন—আপনার কি আর কিছু জানতে বা বুঝতে বাকি থাকবে?
কিরীটীর তোষামোদে মণীশ চক্রবর্তী একটু যেন প্রসন্ন হলেন।
নেহাত লোকটা অবাচীন নয় বোধ হয়, মনে হয় তাঁর।
তবু আপনি তো প্রথম থেকেই এখানে উপস্থিত ছিলেন, তা সত্যিই কি আপনার ব্যাপারটা একটা মার্ডার বলেই মনে হয়? সত্যিই লোকটাকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে আপনি মনে করেন কিরীটীবাবু?
এত তাড়াতাড়ি কি কিছু বলা যায়? আপনিই বলুন না মিঃ চক্রবর্তী, আপনার তো এই লাইনে প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে!
তা ঠিক, তবে জবানবন্দি না নিয়ে কিছু বলতে পারছি না; তবে এটা ঠিক—ওঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করাই হয়েছে। আর ঐ শ্যামলকুমার আর
তারপরই একটু থেমে বললেন, কি নাম যেন মেয়েটির বললেন?
সুভদ্রা।
হ্যাঁ, সুভদ্রা—ওরা দুজনেই এর মধ্যে আছে। বুঝলেন মিঃ রায়, আপনার সব কথা শোনবার পর মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ স্ত্রীলোক-ঘটিত ঈষা। আর সেই ঈর্ষা থেকেই হত্যা।
অসম্ভব নয় কিছু।
০৬. সকলের জবানবন্দি নেওয়া
তাহলে এবার ওদের সকলের জবানবন্দি নেওয়া যাক, কি বলেন মিঃ রায়? কথাটা বলে মণীশ চক্রবর্তী কিরীটীর দিকে তাকালেন।
নিন না। তবে আপনি যদি অনুমতি দেন তো—
কি, বলুন?
এই ঘরে আমি—
থাকবেন জবানবন্দি নেওয়ার সময়?
হ্যাঁ।
থাকুন, থাকুন। আপত্তির কি আছে এতে?
ধন্যবাদ। আপনাদের কাছে কত কিছুর শিখবার আছে। কেমন করে আপনারা জবানবন্দি। নেন, তার process–
শিখতে চান? বেশ, বেশ। কিউরিয়সিটি থাকা ভাল–ওতে জ্ঞানবৃদ্ধি পায়।
কিরীটীর বোধ হয় নোকটার পাকামি সহ্য হচ্ছিল না, তাই বললে, হ্যাঁ, আপনাদের বর্তমান আই.জি. মিঃ মল্লিক তাই বলেন।
মিঃ মল্লিক! তাঁকে আপনি চেনেন নাকি? সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা প্রকাশ পায় মণীশ চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বরে।