- বইয়ের নামঃ সুভদ্রা হরণ
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. কিরীটীর এমন একটা নিষ্ক্রিয়তা
এক এক সময় দেহে ও মনে কিরীটীর এমন একটা নিষ্ক্রিয়তা দেখা দিত যখন সে হয়ত দিনের পর দিন তার বসবার ঘরটা থেকে বেরুতই না। কেউ এলে দেখা পর্যন্ত করত না। দেহ ও মনের ঐ নিষ্ক্রিয় ভাবটা কোন কোন সময় একনাগাড়ে এক মাস দেড় মাস পর্যন্ত চলত। ও যেন ঐ সময়টায় শামুকের মতই নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখত।
বছর তিনেক আগেকার কথা—কিরীটীর সেই সময় ঠিক ঐ অবস্থা চলছিল। সময় তখন গ্রীষ্মকাল।
একে শহরে প্যাচপ্যাচে বিশ্রী গরম—তার উপরে সারা শহর জুড়ে চলেছে সে সময় প্রচন্ড এক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবাধ খুনোখুনি। একে অন্যকে হত্যা করাটা যেন এক শ্রেণীর রাজনৈতিক আশ্রয়পুষ্ট বেপরোয়া কিশোর যুবকদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।
কাউকে রিভলবারের গুলি চালিয়ে, কাউকে পাইপগান দিয়ে, কাউকে রাইফেলের গুলিতে, কাউকে ছোরা মেরে বা বোমার ঘায়ে কাউকে—যে যেমন পারছিল যেন নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল।
খবরের কাগজের পাতা খুললেই নিত্য ঐ ধরনের দুচারটে মর্মন্তুদ হত্যাসংবাদ চোখে পড়বেই।
জনজীবনের সে যেন এক বীভৎস চিত্র। কেবল কি তাই! জনজীবন যেন সর্বদা আতঙ্কিত-সন্ত্রস্ত। মৃত্যু যেন সর্বত্র সর্বক্ষণ ওৎ পেতে আছে।
সকালে হয়ত বেরুল-রাত ফুরিয়ে গেল, আর ফিরলই না।
কাউকে হয়ত চলন্ত বাস থেকে নামিয়ে দিনের আলোয় চারিদিকে মানুষজন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে গেল সকলের চোখের সামনে। রক্তাক্ত মৃতদেহটা তার রাস্তায়ই পড়ে রইল।
বাড়ির কেউ বের হলে না ফিরে আসা পর্যন্ত দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সন্ধ্যার পরই যে যার বাড়িতে ফিরে যায়। সহজ জীবনযাত্রাটাই যেন কেমন থমকে গিয়েছে।
কিরীটীর গড়িয়াহাট অঞ্চলটা কিছু শান্ত। দ্বিপ্রহরে ঘরের মধ্যে বসে কিরীটী ও কৃষ্ণার মধ্যে সেই কথাই হচ্ছিল।
ভৃত্য জংলী এসে ঘরে ঢুকল।
এই জংলী, চা কর! কিরীটী বললে।
চায়ের জল চাপিয়েছি। জংলী বললে, বাইরে একজন বাবু এসেছেন—
বলে দে দেখা হবে না।
কিরীটী কথাটা বলতে জংলী বললে, বলেছিলাম, কিন্তু বাবু শুনছেন না। বলছেন ভীষণ জরুরী দরকার তাঁর–
বলেছিস বুঝি আমি আছি বাড়িতে? কিরীটী খিঁচিয়ে ওঠে।
হ্যাঁ।
ভেংচে ওঠে কিরীটী, হ্যাঁ! তোকে না বলে দিয়েছি কেউ এলে বলবি বাবু বাড়িতে নেই!
কৃষ্ণা বলে, দেখই না কে। নিশ্চয়ই খুব বিপদ, নচেৎ এই প্রচন্ড রোদে এই গরমে কেউ তোমার কাছে আসে! যা জংলী, বাবুকে এই ঘরেই পাঠিয়ে দে।
জংলী চলে গেল। তার ওষ্ঠপ্রান্তে চপল হাসি। মনে হল মনিব-গৃহিণীর হুকুম পেয়ে সে যেন খুশিই হয়েছে।
খুশি হবার জংলীর কারণ আছে। কিরীটীর যখন ঐ ধরনের নিষ্ক্রিয়তা চলতে থাকে জংলীর ব্যাপারটা আদৌ ভাল লাগে না। কেবল একা একা ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকবে বাবু। কারও সঙ্গে দেখা না, কথা পর্যন্ত না—এমন কি মাঈজীর সঙ্গেও কদাচিৎ এক-আধটা কথার বেশী নয়।
কৃষ্ণা উঠে দাঁড়াল। কৃষ্ণা চলে যাবার পরেই সিঁড়িতে জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। সতর্ক জুতোর শব্দ। দরজা ঠেলে আগন্তুক ঘরে প্রবেশ করলেন।
কিরীটী চোখ তুলে তাকাল আগন্তুকের দিকে।
লম্বা ঢ্যাঙা দড়ির মত পাকানো চেহারা। পরনে দামী শান্তিপুরী ফাইন ধুতি ও গায়ে পাতলা আদ্দির পাঞ্জাবি। সারা গা থেকে ভুরভুর করে একটা কড়া দিশী সেন্টের গন্ধ বেরুচ্ছে। গা যেন কেমন গুলিয়ে ওঠে। হাতে একটা মোষের শিংয়ের লাঠি।
নমস্কার। আমার নাম হরিদাস সামন্ত।
কিরীটী নিরাসক্ত কণ্ঠে বললে, বসুন।
হরিদাস সামন্ত বসতে বসতে বললেন, আপনাকে এ সময় বিরক্ত করবার জন্য আমি সত্যিই খুবই লজ্জিত, দুঃখিত রায় মশায়। কিন্তু নেহাত প্রাণের দায়ে—
কিরীটী দেখছিল আগন্তুকের চেহারা ও মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে।
বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বেই হবে বলে মনে হয়। রগের দুপাশের চুলে পাক ধরেছে স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু কেশ বেশ সযত্নে ছাঁটা। মাঝখানে টেরি। কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত কেশ। দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। লম্বাটে ধরনের মুখ। চওড়া কপাল। কপালের রেখা স্পষ্ট। কপালের রেখায়, চোখের কোণে, ভাঙা গালে যেন একটা অমিতাচারের চিহ্ন সুস্পষ্ট। নাকটা সামান্য যেন ভোঁতা, ভাঙা গাল। ধারালো চিবুক। চোখে সোনার দামী ফ্রেমের চশমা।
বড় বিপদে পড়েছি রায় মশাই। দেখুন, আপনি হয়ত সব শুনে বলবেন পুলিসের কাছে। গেলাম না কেন। গেলাম না কারণ তাদের দ্বারস্থ একবার হলে গোপনীয়তা বলে আর কিছু থাকে না। তাছাড়া অন্যপক্ষ যদি জানতে পারে যে পুলিসের সাহায্য আমি নিচ্ছি তাহলে হয়ত সঙ্গে সঙ্গে প্রাণেই শেষ করে দেবে আমাকে। তাই বুঝলেন কিনা—
কথাগুলো বলতে বলতে হরিদাস সামন্ত পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে মুখটা মুছে নিলেন। দেখা গেল দুহাতের আঙুলে গোটা চারেক আংটি। তার মধ্যে বোধ হয় একটা রক্তমুখী নীলা মনে হল কিরীটীর।
কিরীটী চেয়ে চেয়ে দেখছিল হরিদাস সামন্তকে।
মুখটা যেন চেনা-চেনা, কবে কোথায় দেখেছে—ঝাপসা ঝাপসা মনে হচ্ছে।
মাপ করবেন হরিদাসবাবু, আপনাকে যেন আগে কোথাও দেখেছি—