ওদের কথাবাতাঁর মধ্যে চিত্রাঙ্গদা দেবী ঘরে এসে ঢুকলেন।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর দিকে তাকিয়ে কিরীটী যেন সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যায়। গায়ের রঙটা একেবারে টকটকে গৌর। মুখের ও দেহের গঠনটি যেন সত্যিই অনিন্দনীয়। পরনে শ্বেতশুভ্র দামী সিল্কের থান। অনুরূপ ফুলহাতা ব্লাউজ গায়ে। সম্পূর্ণ নিরাভরণা। কিন্তু তথাপি তাঁর চেহারার মধ্যে এমন একটা আভিজাত্য আছে যে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
চোখে সোনার ফ্রেমের সৌখীন চশমা। চোখের দৃষ্টি যেন অন্তর্ভেদী।
বাঁ হাতে একটা সাদা হাতাঁর দাঁতের বাঁটওয়ালা লাঠি।
গত কয়েক বছর ধরে বাতে ভুগছেন, বেশী হাঁটা-চলা করতে পারেন না। এবং হাঁটাচলা যতটুকু করেন, তাও ওই লাঠির সাহায্যেই।–
বড়মা!
জয়ন্ত চৌধুরীই সসম্রামে ডাকে।
চিত্রাঙ্গদা দেবী কিরীটীর মুখের দিকে চেয়েছিলেন।
বড়মা, ইনিই মিস্টার রায়। জয়ন্ত চৌধুরী কথাটা শেষ করে—মানে, অর্জন মিশ্র। নমস্কার। হাত তুলে নমস্কার জানালেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
কিরীটীও প্রতিনমস্কার জানায়।
বসুন। বসো জয়ন্ত।
সকলেই উপবেশন করে, মুখোমুখি সোফায়।
জয়ের কাছে শুনেছেন নিশ্চয়ই সব কথা, মিস্টার মিশ্র?
হ্যাঁ।
আপনি অন্য নামে, অন্য পরিচয়ে এসেছেন, আমি খুব খুশী হয়েছি মিস্টার মিশ্র। বলে চিত্রাঙ্গদা দেবী জয়ন্তর দিকে তাকালেন ঃ ওরা যেন কোন রকম অসুবিধা না হয়, তুমি কিন্তু দেখো জয়ন্ত।
আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। বড়মা। জয়ন্ত বলে।
তুমি কটা দিন এখানে থাকাছ তো? চিত্রাঙ্গদা দেবী শুধালেন।
উৎসব পর্যন্ত আছি।
কেন, কটা দিন বেশি থাক না?
না বড়মা, ঐ সময় আমার পক্ষে বেশি দিন থাকা—
জয়ন্ত চৌধুরীর কথা শেষ হল না, সুরতিয়া এসে ঘরে ঢুকল, রাণীমা!
কি? ভু কুঁচকে তাকালেন চিত্রাঙ্গদা দেবী সুরতিয়ার দিকে।
সুধন্য এসেছে।
কে-কে এসেছে?
সুধন্য। বললাম, রাণীমা এখন ব্যস্ত আছেন, দেখা হবে না। কিন্তু কিছুতেই আমার কথা শুনছে না
সুরতিয়ার কথা শেষ হল না, খোলা দরজাপথে একজন এসে ঘরে ঢুকে পড়ল ঐ সময়।
সকলেরই দৃষ্টি একসঙ্গে গিয়ে আগস্তুকের ওপর পড়ে।
আগস্তুকের চেহারা ও বেশভূষা সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রোগা পাতলা চেহারা। এককালে গায়ের রঙটা হয়ত অত্যন্ত ফর্সাই ছিল, এখন কেমন যেন তামাটে বর্ণ হয়েছে।
একমাথা ঝাঁকড়া ঝাকড়া চুল-লালচে তৈলহীন রুক্ষ। কতকাল যে তেলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই কে জানে! ছোট ছোট পিঙ্গল চোখ, উন্নত নাসা, ঠোঁট দুটো একটু পুরু। মুখভর্তি খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল ও দাড়ির রঙ তামাটে। পরনে একটা কালো গরম প্যান্ট ও গায়ে গলাবন্ধ খয়েরি রঙের গরম কোট। হাতে একটা ফেল্ট ক্যাপ। পায়ে বুট জুতো।
নমস্তে রাণীমা। আগন্তুকই প্রথমে কথা বললে।
আবার কেন এসেছি? তীক্ষ্ম কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন আগন্তুককে চিত্রাঙ্গদা দেবী।
কি করি বলুন, পকেট যে খালি হয়ে গেল!
কথাগুলো বলত বলতে আগন্তুক হাসল। ময়লা একসারি দাঁত যেন বিকিয়ে উঠল। বিরক্তি ভরা কণ্ঠে চিত্রাঙ্গদা বললেন, তুমি না বলেছিলে সেদিন টাকা নেবার সময় আর ছমাসের মধ্যে টাকা চাইতে আসবে না?
বলেছিলাম তো। লেকিন টাকা যে সব ফুরিয়ে গেল।
একটি পয়সাও আর তোমাকে আমি দেব না। যাও বের হয়ে যাও।
গোসা করছেন কেন রাণীমা! সুধন্য is a poor man—তার ওপর গোসা করে কি ফায়দা বলুন! তাছাড়া আপনার কাছে দু-পাঁচশ তো nothing-কিছুই না। কিছু টাকা দিয়ে দিন, চলে যাই। জানি, আমার এ সুরৎ আপনি দেখতে চান না। টাকা দিন কিছু চলে যাই।
একটা পয়সাও আর দেব না তোমাকে আমি। কঠিন কণ্ঠে বলে ওঠেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
দেবেন—দেবেন। আমি জানি, শেষ পর্যন্ত আপনি দেবেনই।
সুরতিয়া? চিত্রাঙ্গদা দেবী ডাকলেন।
রাণীমা! সুরতিয়া এগিয়ে এল।
সুধন্য তাড়াতাড়ি সুরতিয়ার দিকে চেয়ে বলে ওঠে, তুমি যাও সুরতিয়া—অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি, বহুত পিয়াস লেগেছে, এক কাপ গরম চা তৈরী করে আনো। আরো কিছু মিঠাই—ভুক ভি লেগেছে।
ব্যাপারটাকে যেন অত্যন্ত লঘু করে সুধন্য সুরতিয়ার দিকে চেয়ে কথাগুলো বললে।
ওকে এখান থেকে বের করে দে সুরতিয়া! চিত্রাঙ্গদা দেবী সুরতিয়ার দিকে চেয়ে বললেন।
সুরতিয়া কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে। বিব্রত, কেমন যেন মুহ্যমান তাকে মনে হয়।
যাও সুরতিয়া, চা আর মিঠাই নিয়ে এস। সুধন্য আবার বলে সুরতিয়ার দিকে চেয়ে।
সুরতিয়া! তীক্ষ কষ্ঠে আবার ডাকেন চিত্রাঙ্গদা দেবী। কি বললাম শুনতে পাচ্ছিস না!
সুধন্য এবার হঠাৎ এগিয়ে এসে একটা সোফার ওপর বসে পড়ল। এবং এতক্ষণে বোধ হয় তার ঘরের মধ্যে উপস্থিত কিরীটী ও জয়ন্তর দিকে নজর পড়ল।
তাড়াতাড়ি সে আবার সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল, ওঃ, আপনারা এখানে আছেন! আচ্ছা, তাহলে আমি পাশের ঘরেই যাচ্ছি। আপনার কাজ সেরে আপনি আসুন রাণীমা।
সুধন্য কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুরতিয়া আর চিত্রাঙ্গদা দেবী দুজনেই যেন পাথর। অদ্ভূত একটা স্তব্ধতা যেন ঘরের মধ্যে থমথম করে।
কারো মুখে কোন কথা নেই। আকস্মিক ঘটনাটা যেন সকলকেই কেমন স্তব্ধ করে দিয়েছে।
০৬. স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন চিত্রাঙ্গদা দেবী
স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন চিত্রাঙ্গদা দেবীই। বললেন, মিস্টার মিশ্র, আপনারা একটু বসুন, আমি আসছি—
কথাগুলো বলে চিত্রাঙ্গদা দেবী সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং লাঠি হাতে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।