চতুর্থ ভাই শচীন্দ্র ওই সময় এসে ঘরে ঢেকে ঃ ব্যাপার কিরে স্বাতী, হঠাৎ ওপরে চলে এলি কেন? বড়মা ভীষণ রেগে গেছে মনে হল—
তাই বড়মার জন্য বুঝি ওকালতি করতে এসেছী। ছোটদা!
তার মানে?
মানে আর কি, তুমি বড়মাির ভয়ে যেমন সর্বদা জুজুবুড়ী হয়ে আছ, তেমনিই থাক না। গিয়ে-এখানে কেন?
স্বাতীর কথাবার্তাগুলো আজকাল কেমন শুনিছ বড়দা? শচীন্দ্র বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।
সত্যি কথা বলছি কিনা তাই শুনতে খারাপ লাগছে ছোটদা!
ওঃ, দুটো পাস করে যে একেবারে ধরাকে সারা জ্ঞান করছিস রে! শচীন্দ্র টিল্পনী কাটে।
তা তো করবই-এ তো আর গদ্য-কবিতা লেখার মত সহজ নয়!
আগে লিখে নে একটা—তারপর আমন বড় বড় কথা বলিস, শচীন্দ্ৰ বলে ওঠে।
ও যত খুশি তুমিই বসে বসে লেখা গে। আর দু বেলা বড়মার দেওয়া রাজভোগ খাও গে।
তুই নিমকহারাম ছোটলোক কিনা—তাই বড়মার সব উপকার ভুলে গেছিস আজ! তারপর একটু থেমে বলে, গলাধাক্কা দিয়ে যখন বড়মা এ বাড়ি থেকে বের করে দেবে, তখন বুঝবি।
বুঝতেই তো আমি সেটা চাই। বল গে না তোমার বড়মাকে কথাটা।
দেখ স্বাতী, এত তেজ মেয়েমানুষের ভাল না।
যাও যাও, আর উপদেশ দিতে হবে না। কবিতা লেখ গিয়ে, আর তোমার বড়মায়ের পায়ে তেল দাও গে—অপদাৰ্থ কাপুরুষ!
ঘৃণাভরে কথাগুলো বলে স্বাতী মুখ ফিরিয়ে নেয় তার ভাইয়ের দিক থেকে।
কিন্তু আশ্চর্য, শেষ পর্যন্ত দেখা গেল চিত্রাঙ্গদা দেবী যেন স্বাতীর তিনতলায় যাবার ব্যাপারটা মেনেই নিলেন।
প্রথমটায় যতই হ্যাঁকডাক করুন না কেন, স্বাতী ওপরে চলে যাবার পর যেন হঠাৎ চুপ করে গেলেন।
বরং বাড়ির বুড়ি ঝি লখিয়ার মাকে বলে দিলেন, রাত্রে স্বাতীর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে শুয়ে থাকতে।
স্বাতী যেন তিনতলায় গিয়ে কতকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, প্রতি মুহূর্তে এখন আর চিত্রাঙ্গদা দেবীর মুখোমুখি হতে হবে না।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর দুই চোখের সন্দিগ্ধ কুটিল দৃষ্টি তাকে কীটার মত বিধবে না। বাতের জন্য বেশি হাঁটা-চলা আর এখন করতে পারেন না চিত্রাঙ্গদা দেবী—সিঁড়ি বেয়ে যখন-তখন তিনতলায় উঠে আসাটা তো এক-প্রকার দুঃসাধ্যই তাঁর পক্ষে।
০৪. চিত্রাঙ্গদা দেবী
চিত্রাঙ্গদা দেবীর আসন্ন জন্মদিন উৎসব উপলক্ষ্যে ইন্দ্ৰালয়ের সবাই ব্যস্ত।
খুব হৈ-চৈ করে রীতিমত সমারোহের সঙ্গেই চিত্রাঙ্গদা দেবীর জন্মোৎসব পালন করা হয়—৩রা মাঘ।
আর উৎসবটা রায় বাহাদুর হরপ্রসাদের আমল থেকেই হয়ে আসছে। একমাত্র সন্তান— আদরিণী কন্যার জন্মদিনটা খুব সাড়ম্বরেই যেন স্মরণ করিয়ে দিতেন সকলকে প্রতি বছর।
ইন্দ্ৰালয়ের পিছনে যে বাগান, সেখানেই পর পর সব তাবু পড়তো—চারদিকে নানারঙের আলোর উৎসব-যাত্ৰা থিয়েটার পুতুলনাচ ছাড়াও আর একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিল।
হরপ্রসাদ নিজে বরাবর গানবাজনা ভালবাসতেন-নিজে গাইতে ও বাজাতে পারতেনতাই তিনি মেয়ের জন্মদিনটিকে উপলক্ষ্য করে এক বিরাট জলসার ব্যবস্থা করতেন প্রতি বছর-নানা জায়গা থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনতেন গুণীদের, আট-দশ দিন ধরে একটানা গান-বাজনার আসর চলত—আনন্দের স্রোত বইতো।
হরপ্রসাদ তাঁর যেখানে যত আত্মীয় আছে, সকলকেই সেই উৎসবে যোগ দিতে আহ্বান জানাতেন। তাদের যাতাযাত ও ওই কদিন ইন্দ্ৰালয়ে থাকার সব ব্যবস্থা করতেন, এবং ওই উৎসবের ব্যাপারটা হরপ্রসাদের মৃত্যুর পরও চলে এসেছে-চিত্রাঙ্গদার স্বামী জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর প্রচেষ্টাতেই এবং সেটা আরো বেশি জাক-জমকের হয়েছে। জিতেন্দ্রর মৃত্যুর পর বৃদ্ধ সরকার যোগজীবনবাবু—যাকে চিত্রাঙ্গদা বরাবর জীবনকাকা বলে ডেকেছে, তিনিই করে এসেছেন।
অবশেষে জগদীন্দ্রদের আমলে জগদীন্দ্ৰই সেটা নিজের হাতে তুলে নেয়।
কটা দিনের ওই উৎসবে প্রচুর টাকা খরচ করা হয়। আর বিশেষ একটা ব্যাপার হচ্ছে, ওই উৎসবের কাঁটা দিনের জন্য চিত্রাঙ্গদা দেবী তাঁর আভিজাত্য ও দাম্ভিকতার সকল ব্যবধান। ঘুচিয়ে অত্যন্ত সহজ সরল স্বাভাবিকতার মধ্যে যেন নেমে আসেন। প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেন, সহজ ভাবে হাসেন, আনন্দ করেন—সকলের মধ্যে তাদেরই একজন যেন হয়ে যান।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর সে যেন সম্পূর্ণ অন্য এক রূপ। এ যেন সকলের পরিচিত চিত্রাঙ্গদাই নয়। হাসিখুশি ভরা সম্পূর্ণ অন্য একটি মানুষ।
একটি ছোট মেয়ে—যে তার জন্মতিথি উৎসবে আনন্দে মেতে উঠেছে।
কিরীটী যখন ইন্দ্ৰালয়ে এসে পৌঁছল। সোজা কলকাতা থেকে তার গাড়িতেই, ইন্দ্ৰালয় তখন আলোয় আলোয় ঝলমল করছে চিত্রাঙ্গদা দেবীর আসন্ন জন্মতিথি উৎসবের সাজে সজ্জিত হয়ে।
যোগীনবাবু করিডরের একপাশে দাঁড়িয়ে একজন কস্ট্রাক্টরের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তার পাশে ছিল জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্র।
কিরীটীর পরিধানে ইউ. পি.র পোশাক ছিল-চোস্ত পায়জামা, গ্রে কলারের শেরওয়ানী, মাথায় কালো টুপি। চোখে চশমা। মুখে পাইপ।
যোগীনবাবুই সর্বাগ্রে এগিয়ে এলেন কিরীটী গাড়ি থেকে নামতেই তার সামনে।
নমস্তে। কিরীটী বলে যোগীনবাবুকে সম্বোধন করে।
নমস্তে। যোগীনবাবু বলেন, অৰ্জ্জুনপ্রসাদ মিশ্র বোধ হয় আপনি!
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ।
জগদীন্দ্র ও শচীন্দ্র চেয়েছিল কিরীটীর দিকে।
দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা-মাথার চুলে রাগের দুপাশে রুপালী ছোঁয়া লেগেছে। যদিও, তবু মনে হয় বার্ধক্য যেন ঠিক আজও ওর দেহকে ছুঁতে পারেনি।