কিরীটী অতঃপর কি যেন ভাবে কয়েক মূহুর্ত, তারপর বলে, আপনার কথা হয়ত মিথ্যে নয়। কিন্তু সেখানে আমি কি ভাবে যেতে পারি?
সেটা আপনিই ভেবে বলুন।–
আচ্ছা জয়ন্তবাবু, কোষ্ঠীর ব্যাপারে বুঝি চিত্রাঙ্গদা দেবীর খুব বিশ্বাস? কিরীটী মৃদু হেসে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
কিন্তু মিস্টার চৌধুরী, সত্যিই যদি তাঁর এই সময় অপঘাতে মৃত্যুযোগ থাকে, কারো সাধ্য আছে কি তাকে রক্ষণ করার?
সে কি আর আমি বুঝি না! তাছাড়া তারও ধারণা–
কি?
তাঁর মৃত্যু যদি ঘটেই তো ওরাই তাঁকে হত্যা করবে। তাই আরো বেশি করে ওদের গতিবিধির ওপর সর্বক্ষণ প্রখর দৃষ্টি রাখবার জন্যই একজনের সাহায্য আমরা চাই।
কিরীটী আবারও হাসল। তারপর বলল, ঠিক আছে মিস্টার চৌধুরী, আমি যাব। অন্য কোন কারণ নয়—ব্যাপারটা সত্যিই বিচিত্র, তাই যাব। কিন্তু আপনার কি ধারণা বলুন তো?
আমার?
হ্যাঁ।
খুব একটা অসম্ভব নয় কিছু।
কি?
বড়মাকে ওদের কারো পক্ষে হত্যা করা।
কিন্তু কেন বলুন তো?
একটা কথা আপনোক বলা হয়নি মিস্টার রায়–
কি বলুন তো? আমার যে পাঁচজন জোঠতুতো ভাইবোনের কথা একটু আগে আপনাকে বললাম তাদের অবস্থাও আজ কোণঠাসা জন্তুর মত।
কি রকম?
বড়মাকে আপনি দেখেননি—কিন্তু দেখলে বুঝবেন স্ত্রীলোক হলেও তার অদ্ভুত একটা ব্যক্তিত্ব আছে। এবং আছে প্রত্যেকের উপরে প্রভুত্ব করবার একটা অদ্ভুত লিন্সা।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। তাঁর ধারণা চিরদিন, ধারণাই বা বলি কেন মনে হয় স্থির বিশ্বাস যে তার মত সুন্দরী নেই-তাঁর মত বুদ্ধিমতী নেই-তিনি যা করবেন বা করেন, সেটাই ঠিক। তিনি যা বোঝেন, সেটাই শেষ বোঝা। সবাইকে তারই নির্দেশ মেনে চলতে হবে। বলতে পারেন। তীরে এটাই বিচিত্র একটা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স—তাঁর যে গুণ নেই তা নয়—বরং অনেক গুণাই আছে—তাছাড়া মনে স্নেহ-মমতাও আছে। তবু ঐ কমপ্লেক্সটুকুই তাঁর যা কিছু রাহুর মত গ্রাস করেছে—শোনা যায়, ওই কারণেই জেঠামশাইয়ের সঙ্গেও কোন দিন যাকে বলে সত্যিকারের মিল তো হয়নি—দুজনের মধ্যে কোন দিন সত্যিকারের একটা প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি।
Interesting! তারপর?
কিরীটীর চুরুটাটা একসময় নিভে গিয়েছিল, পুনরায় সে তাতে অগ্নিসংযোগ করে নিল।
জয়ন্ত চৌধুরী বলতে লাগল, এবং আমার কি মনে হয় জানেন মিস্টার রায়?
কি?
আমার ধারণা আমার মেজ জেঠামশাইয়ের মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে বড়মা তার ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তার মধ্যেও বড়মার অসহায়দের জন্য মমতা বা দায়িত্ববোধের চাইতেও হয় বেশি ছিল কতকগুলো অসহায় ছেলেমেয়ের উপর তার সেই আধিপত্য বিস্তার বা dominate করবার লিন্সটাই। কিন্তু হাজার হলে ওরাও তো মানুষ-দুর্ভাগ্যের জন্যে ওদের বড়মার আশ্রয়ে যেতে হলেও দিনের পর দিন তাঁর ঐ নিষ্ঠুর বিলাস তাদের সহ্যশক্তির ওপর মর্মান্তিক ভাবে পীড়ন করেছে হয়ত এবং যার ফলে আজ তারা সত্যিই মরীয়া হয়ে উঠেছে; এবং সত্যিই হয়ত ওরা আজ বড়মাকে হত্যাও করতে পারে তাঁর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যেই। হয়ত আমারও অবস্থা ওদেরই মত হত। আমার বাবার মৃত্যুর পর ওঁর ইচ্ছাক্রমে ওঁর ওখানে গিয়ে আশ্রয় নিলে, কিন্তু thank God—ভগবান আমায় বঁচিয়েছেন। মামারা আমাকে আশ্রয় দিয়ে মানুষ করে তোলেন।
কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না মিস্টার চৌধুরী, একদিন না হয় ওরা অসহায় ছিল। কিন্তু আজ তো ওদের বয়স হয়েছে, আজও তাহলে ওরাই বা কেন দিনের পর দিন ওইভাবে পীড়ন সহ্য করে ওখানে পড়ে আছেন?
সেটা তো খুবই স্বাভাবিক—জেঠিমার সম্পত্তির লোভে। শুনলেন তো সব কটাই অপদার্থ-নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবার মত কোন শক্তি নেই।
কিন্তু আপনাদের বড়মা যে ওদেরই তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে যাবেন, তারই বা স্থিরতা কোথায়? তিনি যেরকম বিচিত্র প্রকৃতির স্ত্রীলোক-হয়ত একটি কপর্দকও কাউকে দেবেন। না তাঁর বিপুল সম্পত্তির—
না, তিনি already উইল করে দিয়েছেন।
কি উইল করেছেন?
শুনেছি। ওদের প্রত্যেকের জন্যেই একটা মোটা মাসোহারা ও নগদ টাকার ব্যবস্থা করেছেন তার উইলো।
ওঁরা কি সেকথা জানেন?
নিশ্চয়ই জানে।
কিরীটী অতঃপর চুপ করে থাকে।
তারপর বলে, কিন্তু সত্যিই কি আপনি মনে করেন জয়ন্তবাবু—তারা তাদের আশ্রয়দাত্রী জেঠিমাকে শেষ পর্যন্ত মাত্র ঐ কারণেই হত্যা করতে পারেন!
অন্ততঃ আমি হলেও পারতাম মনে হয়—
ঠিক আছে। কবে সেখানে যেতে হবে বলুন?
আজ আপনি পারলে কাল নয়।
বেশ। আমি সামনের শনিবার যাব।
আমি এসে আপনাকে তাহলে নিয়ে যাব।
না, আমি একাই যাব। আপনি কেবল আপনার বড়মাকে গোপনে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখবেন।
গোপনে!
হ্যাঁ আমার সেখানে যাবার ব্যাপারটা যেন তারা কেউ না জানতে পারেন।
কিন্তু—
কি ভাবে, কি পরিচয়ে যাব বুধবার আপনাকে জানাব।
বেশ। জয়ন্ত চৌধুরী উঠল।
০৩. ধানবাদ শহর থেকে
ধানবাদ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরেই ইন্দ্ৰালয়।
পাহাড়ের মত একটা উঁচু জায়গায় ইন্দ্ৰালয়! বাড়িটা যেন দূর থেকে অবিকল একটা দুর্গের মত মনে হয়। বড় রাস্তা থেকে পাথরের তৈরী একটা চওড়া রাস্তা ঘুরে ঘুরে সোজা রাস্তা যেন ইন্দ্ৰালয়ের গেটের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়িটা। তিনতলা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে বাগান, তার মধ্যেই রেস্ট-হাউস, আস্তাবল, গ্যারাজ ও চাকর-দারোয়ানদের থাকবার আস্তানা।