বুঝতে পারছি না। সুরতিয়া?
নেহি তা!
এটা তোমারই হাতের একটা ভাঙা চুড়ির টুকরো।
আমার?
হ্যাঁ যেটা সে-রাত্রে ভেঙে ঘরের মধ্যে পড়েছিল হয়তো।
আমার চুড়ি-ভাঙা!
হ্যাঁ, তোমারই। আর এটা কখন ভেঙেছিল জান?
কখন?
সে-রাত্রে-গণেশকে ডেকে দেবার পর, গণেশ তোমার রাণীমার ঘরে ঢুকে জয়ন্তবাবুকে ডাকতে বের হয়ে যাবার পর। এখন বল সে-রাত্রে রাণীমার নির্দেশে গণেশকে ডেকে দেবার পর তুমি কোথায় গিয়েছিলো।
কেন, নীচে বাগানে যেখানে গানবাজনা হচ্ছিল–
না।
বিশোয়াস কিজিয়ে বাবুজী–
নেহি, তুম ঝুট কহোঁতে হো।
ঝুট!
হ্যাঁ বুট—সাচ্ সাচ্ বাতাও।
লেকেন বাবুজী–
সাচ্ বাত ছুপানেসে কুছ ফায়দা নেহি হোগা—বাতাও—
সুরতিয়া বোবাদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটী বলে চলে, গণেশকে ডেকে দিয়ে সোজা তুমি বাগানে যাওনি সে-রাত্রে। কোথায় গিয়েছিলে বল?
সুরতিয়া চুপ।
আমার ধারণা যদি মিথ্যে না হয় তো সে-রাত্ৰে তুমি নীচে আমার ঘরে ঢুকে যে পথ দিয়ে এইমাত্র আমি এসেছি, সে পথ দিয়ে গোপনে ওপরে উঠে আসো—, তারপর বল তুমি কি করেছ?
আপনার কথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না বাবুজী। আমি কেন আবার ওপরে আসব?
এসেছিলে তোমার কাজে এবং তার প্রমাণও আছে।
লোকেন। কিউ?–
কিউ? হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে, সুধন্য কে?
সুধন্য!
বল সে কে?
ওকে আমি চিনি না।
চেন।
নেহি!
আমি তাহলে বলি সুধন্য তোমার কে, তোমার ছেলে।
বাবুজী!
হ্যাঁ-রাজাবাবুর ঔরসে তোমার গর্ভে ওর জন্ম।
না, না–
আর্ত চিৎকার করে ওঠে সুরতিয়া।
হ্যাঁ, তোমার ছেলে। আর সেকথা তোমার রাণীমাও জানতেন বলেই নিজের স্বামীর লজ্জাকে ঢাকবার জন্য-নিজের আভিজাত্যকে বাঁচানোর জন্য তোমার এবং পাছে তুমি সব কথা প্রকাশ করে দাও, সেই ভয়ে সুধন্যকে থেকে থেকে টাকা দিয়ে এসেছেন বারবার। কেমন, তাই নয় কি!
সুরতিয়া একেবারে নিশ্চুপ।
সুধন্য তোমার ছেলে অবিশ্যি সে কথাটা এখনো জানে না। কিন্তু তোমার ব্ল্যাকমেলিং ক্রমশঃ যখন দিনের পর দিন বেড়েই চলতে লাগল, তখন তিনি আক্রোশের মাথায় বলে বসেন উইল তিনি বদল করবেন—যে উইলে সুধন্যরও একটা মোটা শেয়ারের ব্যবস্থা ছিল তার সম্পত্তির–
কিরীটীর কথা শেষ হল না—একে একে ওই সময় ঘরে এসে ঢুকল জগদীন্দ্র, মণীন্দ্ৰ, ফণীন্দ্র, শচীন্দ্র, স্বাতী, যোগেনবাবু, চৌবেজী ও সবশেষে জয়ন্ত।
এই যে আসুন আপনারা।
হঠাৎ জয়ন্তকে ঘরে ঢুকতে দেখে যেন একটা ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতই কোমর থেকে ধারালো একটা ছোরা বের করে জয়ন্তর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুরতিয়া।
বেইমান।
সকলে মিলে সুরতিয়াকে ধরে ফেলবার আগেই ছোরাটা জয়ন্তর হাতে বিঁধে গিয়েছিল তবে বেশী আঘাত লাগেনি।
চৌবেজী ও মণীন্দ্র দুজনে সুরতিয়াকে দু হাতে শক্ত করে ধরে ফেলেন।
সুরতিয়া তখনো ক্ষিপ্ৰ বাঘিনীর মত চেঁচাচ্ছে, ছোড় দো—ছোড় দো মুঝে-ও বেইমানকে হাম খতম কর দুঙ্গি।
চৌবেজীর ইঙ্গিতে দুজন পুলিস এসে ধরে সুরতিয়াকে।
কিরীটী বলে, বলেছিলাম চৌবেজী, আততায়ীকে আজ ধরিয়ে দেব। হাতকড়া লাগান, সে-রত্রে সুরতিয়াই চিত্রাঙ্গদা দেবীকে হত্যা করেছিল আর ঐ ছোরাটা দিয়েই।
১৬. ঘরের মধ্যে বজ্রপাত
ঘরের মধ্যে যেন সহসা বজ্রপাত হল।
সকলেই স্তম্ভিত, নির্বাক।
আরো কিছুক্ষণ পরে—সুরতিয়াকে পুলিস-ভ্যানে তুলে হাজতে পাঠাবার পর চিত্রাঙ্গদা। দেবীর ঘরে বসেই কিরীটী ওদের সকলকে সমস্ত কাহিনী বিবৃত করে।
কিরীটী বলতে থাকে, প্রথম দিনই চিত্রাঙ্গদা দেবী সুধন্যকে নিয়ে তাঁর শয়নঘরে চলে যাবার পর চিত্রাঙ্গদা দেবীর স্বামী জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর ফটোটার দিকে আমার নজর পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের পাতায় ভেসে ওঠে সুধন্যর মুখটা।
দুটো মুখের মধ্যে আশ্চর্য মিল!
তারপরই সুধন্যকে ওইভাবে চিত্রাঙ্গদা দেবীর কাছে বার বার এসে টাকার দাবি করা ও চিত্রাঙ্গদা দেবীর টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা মনের মধ্যে আনাগোনা করতে থাকে আমার।
বুঝতে পেরেছিলাম আমি—কোন গূঢ় কারণ না থাকলে চিত্রাঙ্গদা দেবীর মত মানুষ সুধন্যকে টাকা দেয় না। বিশেষ করে যাকে তিনি সবচাইতে বেশী ঘৃণা করতেন।
ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কি সে কারণ-কি?
তারপর শুনলাম ভূপৎ সিং ও তার স্ত্রী সুরতিয়ার কথা ও সুরতিয়ার প্রতি জিতেন্দ্র চৌধুরীর আকর্ষণের কথাটা।
সঙ্গে সঙ্গে যেন দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল। সব পরিষ্কার হয়ে গেল।
জয়ন্ত প্রশ্ন করে, কিন্তু ওকে আপনি সন্দেহ করলেন কি করে?
কিরীটী বলে, নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে, আমি বার বার বলেছি সে-রাত্রে বিশেষ কোন পরিচিত জন, যার এ বাড়ির মধ্যে অবাধ গতিবিধি, তাদেরই কেউ একজন চিত্রাঙ্গদা দেবীকে হত্যা করেছে!
হ্যাঁ।
এবারে মনে করে দেখুন, সেরকম এ বাড়িতে কে কে ছিল—ওঁরা চার ভাই ও আপনি ছাড়া আর একজন, সে হচ্ছে ঐ সুরতিয়া—যে রাণীমার একপ্রকার প্রত্যক্ষ সহচরী ছিল সৰ্বক্ষণের। মণীন্দ্রবাবু ও জগন্দ্রীবাবুকে অনায়াসেই বাদ দিয়েছি, কারণ ওই সময় তারা গানের আসরে ছিলেন। অর্থাৎ যে সময় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। শচীন্দ্র ও ফণীন্দ্রবাবুকে পরে জিজ্ঞাসাবাদ করে বাদ দিই সন্দেহের তালিকা থেকে।
তাছাড়া ওঁরা চারজন আর যাই করুন, হত্যা করবার মত নাৰ্ভ বা মনের জোর তাদের কারোরই ছিল না। তাহলে বাকি থাকে দুজন—জয়ন্তবাবু ও সুরতিয়া। এবং ওদের দুজনের মধ্যে সবচাইতে সে-রাত্রে হত্যা করবার সুবিধা কার বেশী ছিল! সেটা ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল সুরতিয়ার একটা কথা, কালো কোট পরিহিত যে লোকটিকে সুরতিয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে দেখেছিল তাকে নাকি তার জয়ন্তবাবু বলে মনে হয়েছিল।