কি বলেছিলেন তিনি ঠিক?
স্বাতীর বিয়ের কথা বলতেই হঠাৎ তিনি চটে উঠলেন। বললেন, তোমাদের যার যা খুশি তোমরা করতে পার—যেখানে যার খুশি তোমরা এই মুহুর্তে এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পার। পথের ভিখারী—তোমাদের এনে ক্ষীর আর ঘিয়ের বাটি মুখে তুলে দিয়েছিলাম। এখন দেখছি সে দয়াটা তোমাদের প্রতি দেখানেই আমার ভুল হয়েছে। পথের কুকুর চিরদিন পথের কুকুর থাকে—তাই সব থাকো গে। দূর হয়ে যাও সব এখান থেকে, তোমাদের কারো সঙ্গেই আমার কোন সম্পর্ক নেই—“কালই আমি নতুন উইল করে তোমরা কেউ যাতে একটি কপর্দকও না পাও সে ব্যবস্থা করছি।
তারপর?
আমারও হঠাৎ রাগ হয়ে গেল—আমিও কড়া কড়া কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলাম বড়মাকে।
কি বলেছিলেন তাতে তিনি?
বলেছিলেন, তোমাদের সব চাবুক মারা উচিত থামের সঙ্গে বেঁধে, নিমকহারাম কুত্তার দল! তাতে আমি বলেছিলাম–
কি?
তাহলে তোমাকে জ্যান্ত রাখব না জেনো।
বলেছিলেন আপনি?
হ্যাঁ—যা কোনদিন হয় না—হঠাৎ যেন মাথার মধ্যে আমার আগুন জ্বলে উঠেছিল। পরে নিজেই অবাক হয়েছি কি করে বলতে পারলাম ও কথাগুলো বড়মাকে!
মারতে মারতে নিরীহ একটা বিড়ালছনাকে কোণঠাসা করলে, সেও শেষ পর্যন্ত থাবা তুলে নখর বের করে শেষবারের মত ঝাঁপিয়ে পড়বার চেষ্টা করে মণীন্দ্রবাবু, আপনিও ঠিক তাই করেছিলেন।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে আমার মনের কথা নয়-রাগের মাথায় যাই বলে থাকি না কেন—
কিরীটী মৃদু হাসে।
মণীন্দ্র বলে, তাকে হত্যা করব আমাদের স্বপ্নেরও অতীত।
মণীন্দ্রবাবু, একটা কথা–
মণীন্দ্র কিরীটীর দিকে তাকাল।
সে-সময় ঘরে আর কে ছিল মনে আছে আপনার?
সুরুতিয়া ছিল।
আর কেউ না?
না, তবে বের হয়ে যাবার মুখে জয়ন্তদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে দরজার কাছেই। দাঁড়িয়েছিল, তাই মনে হয়–
কি?
সেও আমাদের সব কথা শুনেছিল।
ঠিক আছে, আপনি এখন আসুন।
কিরীটীবাবু!
বলেন?
আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন, আমাদের ভাইদের মধ্যেই কেউ একজন–
সেটা ভাবাই তো স্বাভাবিক।
কেন?
কারণ তাঁর পূর্বের উইল বদল করবার ইচ্ছাটা। সেই আশঙ্কায় তাঁকে আপনাদের হত্যা করাটা খুবই তো স্বাভাবিক।
না না, তাই বলে হত্যা করব?
মানুষ মানুষকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, একমাত্র দুর্ধর্ষ ক্রিমিন্যাল ছাড়া, চরম কোন উত্তেজনার মুহুর্তেই হত্যা করে বসে বা চরম আঘাত হেনে বসে।
মণীন্দ্র আর কোন কথা বলে না।
ধীরে ধীরে একসময় নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
আর কিরীটীও যেন নিজের চিন্তায় নিজে ড়ুবে যায়।
তার পরদিনই ভোরবেলা কিরীটী কলকাতায় চলে গেল এবং একদিন পরে আবার সন্ধ্যায় ফিরে এল।
কাল—আগামী কালই, কিরীটী চৌবেজীকে বলেছে আততায়ীকে ধরিয়ে দেবে।
কিরীটী ফিরে এসেছে শুনে জয়ন্ত চৌধুরী তার ঘরে এসে ঢোকে।
আসুন জয়ন্তবাবু।
মিস্টার রায়, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এলাম।
কি বলুন তো?
এভাবে কতদিন আর নজরবন্দী হয়ে এই ইন্দ্ৰালয়ে থাকতে হবে?
দুঃখের রাত্রি অবসান-প্রায়?
অবসান-প্রায়?
হ্যাঁ। বসুন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
তারপর কিরীটী ও জয়ন্তর মধ্যে প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে কথাবার্তা হল এবং রাত পৌনে আটটা নাগাদ জয়ন্ত কিরীটীর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী তার ক্লান্ত দেহটা আরামকেদারার ওপর শিথিল করে দেয়।
১৫. ইন্দ্ৰালয়
পরের দিন রাত্রে।
রাত তখন বারোটা বেজে গিয়েছে।
সমস্ত ইন্দ্ৰালয় যেন একেবারে নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে গিয়েছে। কিরীটী আলো জ্বেলেই শুয়ে ছিল শয্যার ওপর চোখ বুজে। ঘুমোয়নি। ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতে দেখে শয্যা হতে উঠে পড়ল।
প্রস্তুত হয়েই ছিল সে। উঠে প্রথমেই ঘরের আলোর সুইচটা টিপে নিভিয়ে দিল। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।
বাইরের বাগানে ঝি ঝি ডাকছে। একটানা বিবির শব্দ নিযুতি রাতের কান্নার মতই যেন মনে হয়।
অন্ধকারেই কিরীটী তার শয়নঘরের মধ্যস্থিত গুপ্ত দরজা খুলে—যে দরজাপথে জয়ন্ত তাকে প্রথম রাতে গোপনে অন্য একটা সিঁড়ি দিয়ে চিত্রাঙ্গদা দেবীর বসবার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যায়।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর বসবার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কিরীটী।
দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কিরীটী বন্ধ দরজাটার গায়ে টুক টুক টুক করে পর পর তিনটি মৃদু টোকা দিল। ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল।
ঘর অন্ধকার।
কিরীটী চট করে ঘরের দরজা খুলতেই ভেতর ঢুকে যায়।
কে?
কিরীটি সে-কথার কোন জবাব না দিয়ে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল।
সামনেই দাঁড়িয়ে সুরতিয়া।
বাবুজী আপ?
হ্যাঁ সুরতিয়া, তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
কেয়া আপ পুঝনে চাহতে হে বাবুজী মুঝসে?
কিরীটী সুরতিয়ার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত, তারপর তার জামার পকেট থেকে সেদিন চিত্রাঙ্গদা দেবীর শয়নঘরের মেঝেতে কুড়িয়ে পাওয়া ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরোটা বের করে সামনে মেলে ধরে বলে, দেখ তো সুরতিয়া, এটা কি।
সুরতিয়া একটু যেন অবাক হয়ে কিরীটীর হাতের পাতায় ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরোটার দিকে তালিয়ে পালটা প্রশ্ন করে, কেয়া!
বুঝতে পারছ না?
মালুম হোতা হ্যায় চুড়িয়া কি টুকরা!
ঠিক। কিন্তু কোথায় পেয়েছি জান এটা?
কোথায় বাবুজী?
সে-রাত্রে রাণীমার ঘরের মেঝেতে। রাণীমার হাতে তো কাচের চুড়ি ছিল না। আর তোমার দিদিমণির হাতেও নেই—আছে দেখছি তোমার হাতে।
কেয়া মতলব?