বেশ তো, বলুন না শুনি।
এক জঘন্য প্রকৃতির নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন প্রকৃতির স্ত্রীলোক ছিলেন তিনি।
কি রকম?
সে ইতিহাস বর্ণনা করতে গেলে পুরো দিন লেগে যাবে। কিন্তু জয়ন্তদাও তো তাকে চিনত, তার কাছেও কিছু আপনি আগে শোনেননি?
শুনেছি কিছু কিছু, আপনিও বলুন না।
এই যে দেখছেন আমার সহোদর ভাই কাটিকে, এদের চারটেকে একেবারে ভেড়া করে রেখেছিল মহিলা। এই যে বাড়িটা-ইন্দ্ৰালয় যার নাম—এর আসল নাম কি হওয়া উচিত ছিল জানেন? নরকালয়। কতকগুলো জ্যান্ত মানুষকে অনুকম্পা ও সাহায্য করার ভান করে দিনের পর দিন রাতের পর রাত চরম জঘন্য নির্যাতন চালিয়েছে, আর তার ফলে যা হবার ঠিক তাই হয়েছিল, এরা সকলে মুখে যতই শ্রদ্ধা ও প্রীতি জানাক না কেন, মনে মনে করত প্রচণ্ড ঘৃণা।
ঘৃণা!
হ্যাঁ, ঘৃণা। অথচ মজা কি জানেন, তবু এরা কেউ বিদ্রোহ করতে পারেনি—এই বিচিত্র বন্দীশালা ছেড়ে চলে যেতে পারেনি। এর চেয়ে দুঃখ, লজ্জা ও ভীরুতার আর কি থাকতে পারে বলতে পারেন?–
একটু থেমে স্বাতী আবার বলে, কাজেই আজ যা ঘটেছে, সে তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে আমার, আমি যখন এই বন্দীশালা ছেড়ে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছি, ঠিক সেই মুহুর্তে ব্যাপারটা ঘটল।
আপনি কি
হ্যাঁ, সকালেই অনিন্দ্যর আসার কথা—আমাকে সে নিয়ে যাবে। এখান থেকে বলে গিয়েছে।
আপনার চলে যাবার কথাটা আপনার বড়মা জানতেন?
হ্যাঁ।
আপনি বলেছিলেন বুঝি?
হ্যাঁ, কাল দুপুরেই জানিয়ে দিয়েছিলাম।
তিনি কি বলেছিলেন?
বলেছিল, তাহলে তার সম্পত্তির একটা কপর্দকও আমি পাব না। আমিও সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছিলাম তাকে-চাই না।
তাহলে দুপুরে আপনার সঙ্গে আপনার বড়মার দেখা হয়েছিল?
হ্যাঁ।
আপনার মেজদা কথাটা জানতেন কি?
হ্যাঁ, তাকে বলেছিলাম।
কিরীটী এবার শচীন্দ্রর দিকে ফিরে তাকাল, আপনার নামই শচীন্দ্ৰ চৌধুরী?
হ্যাঁ।
আপনি আপনার ঘরেই ছিলেন এতক্ষণ বোধ হয়?
হ্যাঁ।
গানের আসরে যাননি?
না, ওসব আমার ভাল লাগে না।
আচ্ছা শচীনবাবু, শেষ আপনার বড়মার সঙ্গে কখন দেখা হয়?
গতকাল সন্ধ্যায়।
কি কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আপনার?
বিশেষ কিছুই না।
ক্রমশ রাত শেষ হয়ে আসে।
আসর ইতিমধ্যে ভেঙে গিয়েছিল, অতিথি-অভ্যাগতরাও একে একে ইন্দ্ৰালয় ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
১৩. দুঃসংবাদটা চাপা থাকে না
দুঃসংবাদটা চাপা থাকে না। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ-কান ও-কান হতে হতে সংবাদ সমস্ত ইন্দ্ৰালয়ে ছড়িয়ে যায়।
কিরীটীর অনুরোধে চৌবেজী ইন্দ্ৰালয়ে পুলিস-প্রহরা মোতায়েন করেছিলেন ইতিমধ্যে এবং নির্দেশ জারি করে দিয়েছিলেন তাঁর বিনানুমতিতে কেউ ইন্দ্ৰালয় ছেড়ে আপাততঃ যেতে পারবে না।
সকলকেই আপাততঃ নজরবন্দী থাকতে হবে। রীতিমত এক অস্বস্তিকর পরিবেশ।
উৎসব আরো কদিন হবার কথা ছিল, কিন্তু চিত্রাঙ্গদা দেবীর আকস্মিক মৃত্যু আততায়ীর হাতে হঠাৎ যেন সব কিছুর ওপর একটা পুর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছিল। আনন্দ-কোলাহল মুখরিত ইন্দ্ৰালয়ের ওপরে হঠাৎ যেন শোকের একটা কালো ছায়া নেমে এসেছে।
উৎসব থেমে গিয়ে যেন একটা শ্মশান-স্তব্ধতা নেমে এসেছে ইন্দ্ৰালয়ের ওপর।
দুটো দিন আমনি করে কেটে গেল আরো।
কিরীটী মধ্যে মধ্যে এক-একজনকে আলাদা করে তার ঘরে ডেকে এনে আরো কিছু কিছু প্রশ্ন করেছে এবং সবাই জানতে পেরেছে কিরীটীর কথায়, পুলিস এবং তার ধারণা, বাইরের কেউ চিত্রাঙ্গদা দেবীর নৃশংস হত্যার জন্য দায়ী নয়।
হত্যা করেছে। চিত্রাঙ্গদা দেবীকে বাড়ির মধ্যে যারা সে-রাত্ৰে উপস্থিত ছিল, অর্থাৎ চিত্রাঙ্গদা দেবীর কোন আপনজনই, বিশেষ করে যাদের অন্দরে ও চিত্রাঙ্গদা দেবীর ঘরে অবাধ গতিবিধি ছিল।
কথাটা শোনা অবধি সকলেই যেন হঠাৎ কেমন বোবা হয়ে গিয়েছে। সকলেই পরস্পর মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছে সর্বক্ষণ। একের অন্যের প্রতি কেমন যেন সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের দিকে কেমন সন্দেহ নিয়ে তাকাচ্ছে।
কে—তাদের মধ্যে কে? কে হত্যা করল চিত্রাঙ্গদা দেবীকে?
জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্ৰ, ফণীন্দ্র, শচীন্দ্র ও জয়ন্ত, বিশেষ করে ওই পাঁচজন—পাঁচ ভাইয়ের মনেই যেন ওই কথাটা ঘুরে ফিরে উদয় হয়।
স্বাতীও তাকায় তার ভাইদের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে।
কে-কে হত্যা করল?
আর ওদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে সুধন্যও।
কেউ কারো সঙ্গে মন খুলে কথা পর্যন্ত যেন বলতে পারছে না, কথা বলতে গিয়ে থেমে যাচ্ছে।
সবাই যেন নিজের নিজের মনের মধ্যে গুমরোচ্ছে। বিশ্ৰী অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতি।
সেদিন দুপুরে কিরীটী তার ঘরের মধ্যে বসেছিল, বাইরে ফণীন্দ্রর গলা শোনা গেল।
মিস্টার রায় আসতে পারি?
আসুন—আসুন! ডান পা-টা খোঁড়া ফণীন্দ্রর। ডান পা-টা একটু টেনে টেনে আস্তে আস্তে চলে সে। পা টেনে টেনে ফণীন্দ্র এসে ঘরে ঢুকল।
বসুন।
মিস্টার রায়!
বলুন?
এরকম করে তো আর পারছি না মিস্টার রায়—এই যে সৰ্বক্ষণ এক সন্দেহের দুঃসহ যন্ত্রণা-সত্যি বলছি, আর কাঁটা দিন এভাবে থাকলে হয়ত পাগল হয়ে যাব।
আমি তো আপনাদের প্রত্যেককেই বলেছি। ফণীন্দ্রবাবু, আপনারা যে যা জানেন—কোন কথা গোপন না করে অকপটে আমাকে জানতে দিন। তাহলে এভাবে আপনাদের কষ্ট পেতে হয় না। —আমিও ব্যাপারটার একটা মীমাংসায় পৌঁছতে পারি।
কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, সব কথাই আপনাকে অন্ততঃ আমি বলেছি।