কিরীটী মৃদু হেসে বলে, না, পালাবে না। তাছাড়া পালালে তো ক্ষতি নেই কিছু।
ক্ষতি নেই!
না। সুধন্য হত্যা করেনি।
কি করে বুঝলেন?
স্বর্ণডিম্বপ্রসূ হংসীকে হত্যা করবে নিজের হাতে, অন্তত এত বড় গদর্ভ সুধন্য নয়।
স্বর্ণডিম্বপ্রসূ হংসী!
হ্যাঁ-চিত্রাঙ্গদা দেবী তো ওর কাছে তাই ছিলেন। এলেই টাকা পেত-তা সে যে কারণেই হোক। আর সেই টাকাই যে ওর ভরসা, সেও আমি জানি।
কিন্তু—
না মিস্টার চৌধুরী, হত্যাকারী শুধু ক্ষিপ্ৰগতিসম্পন্নই নয়, অসম্ভব তার নার্ভ এবং বুদ্ধি। এবং তার হত্যার পিছনে বড় রকমের কোন মোটিভ রয়েছে জানবেন।
কিন্তু—
হ্যাঁ—আপাততঃ যা আমার মনে হচ্ছে, হত্যাকারী পূর্ব হইতে প্রস্তুত হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র এতটুকুও দেরি করেনি। আর —সঙ্গে সঙ্গে চরম আঘাত হেনেছে, তারপর সরে পড়েছে।
বাইরে ওই সময় পদশব্দ পাওয়া গেল।
দেখুন তো কে এল!
জয়ন্তকে উঠে দেখতে হল না, থানার অফিসার মিঃ চৌবে ও চিত্রাঙ্গদা দেবীর সরকার যোগেন বা যোগীন মিত্র ঘরে এসে ঢুকল।
এই যে জয়ন্তবাবু,-যোগেন মিত্ৰই প্রথমে কথা বলে, কি ব্যাপার? আমাকে ডেকেছেন কেন? আর মিস্টার চৌবেই বা–
কথা বললে এবারে কিরীটী, প্রয়োজন ছিল মিত্রমশাই।
কি বলুন তো? একটু যেন বিস্মিত হয়েই যোগেন মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
বিস্ময়ের তার কারণ ছিল, কারণ কিরীটীর সত্যি পরিচয়টা সে জানে না এখনো। অথচ এত রাত্রে এ ঘরে–
কিরীটী আবার বলে, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনা!
হ্যাঁ। মিসেস চৌধুরী অর্থাৎ আপনাদের রাণীমা—
কি-কি হয়েছে তার? ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করে যোগেন মিত্র।
তিনি খুন হয়েছেন।
সে কি!
হ্যাঁ।
কিরাটাই তখন সংক্ষেপে ব্যাপারটা বিবৃত করে।
চৌবেজী এবার বলে, কিন্তু আপনি কে?
এবারে জয়ন্ত তার পরিচয় দিল, উনি বিখ্যাত রহস্যসন্ধানী কিরীটী রায়।
সত্যি! নমস্তে—নমস্তে বাবুজী। চৌবেজীর কণ্ঠস্বর শ্রদ্ধায় একেবারে বিগলিত, কি সৌভাগ্য, আপনার দেখা পেলাম!
যোগেন মিত্র বলে, তাহলে আপনি যে বলেছিলেন জয়ন্তবাবু—
জয়ন্তবাবু তখন সংক্ষেপে কিরীটীর এখানে আসার ব্যাপারটা বলে গেল, বড়মার ইচ্ছাক্রমেই সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মৃতদেহ পরীক্ষা করল চৌবে।
চেয়ে বললে, তাজ্জব কি বাত— এইসা কেইসে হো সেকতা মেরে সমঝ মে নেহি আতা রায় সাহাব! আপকে রায় কেয়া হ্যায়?
কিরীটী বলে, যতদূর বুঝতে পারছি, আততায়ী মিসেস চৌধুরীর কোন অপরিচিত জন নন—কোন বাইরের লোকও নয়।
তব কৌন হো সেকতা?
সেটা এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না—সকলের সঙ্গে কথাবার্তা না বললে—
কিরীটীর কথা শেষ হল না, জগদীন্দ্ৰ প্ৰথমে ও তার পশ্চাতে মেজ মণীন্দ্র এসে ঘরে ঢুকল, এবং ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই যুগপৎ ওদের কণ্ঠ হতে একটা অস্ফুট আর্তচিৎকার নিৰ্গত হয়, এ কি!
তারপরই যেন দু ভাই বোবা হয়ে গেল। প্রস্তরমূর্তির মত ভূপতিত প্রাণহীন রক্তাক্ত দেহতার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
গানের আসর। তখনো ভাঙেনি। গানের সুর তখনো শোনা যাচ্ছে।
একপাশে সুরতিয়া তখনো পাথরের মত নিশ্চল দাঁড়িয়ে।
চৌবেজীই কথা বলে, চলিয়ে সাব, ও কামরামে চলিয়ে।
চৌবেজীর সঙ্গে সঙ্গে জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্র, যোগেন মিত্র ও জয়ন্ত পাসের ঘরে চলে গেল। কিরীটী চৌবেজীকে সম্বোধন করে বললে, আপ যাইয়ে চৌবেজী, ম্যায় আতা হুঁ।
১২. সুরতিয়া
সুরতিয়া!
কিরীটীর ডাকে সুরতিয়া ওর মুখের দিকে তাকাল। ফ্যাকাশে বিবৰ্ণ মুখ।
সুরতিয়া!
বাবুজী!
তুমি তো ভূপৎ সিংয়ের স্ত্রী, তাই না?
কথাটা শুনে হঠাৎ যেন চমকে ওঠে সুরতিয়া, কয়েকটা মুহুর্ত কোন জবাব দিতে পারে না। তারপর ধীরে ধীরে নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
শোন সুরতিয়া, আমি তোমার অনেক কথাই জানি—
সুরতিয়ার দুচোখের দৃষ্টিতে যেন একটা অজানিত আশঙ্কা ঘনিয়ে ওঠে। নিঃশব্দে চেয়ে থাকে ও।
কিরীটী আবার বলে, তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, তার ঠিক ঠিক জবাব দাও। জবাব না দিলে জানবে যাকে তুমি বাঁচাবার চেষ্টা করছ, তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
সুরতিয়া তথাপি নীরব।
রাজাবাবুর সঙ্গে তোমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, সত্যি কিনা?
সুরতিয়া নীরব। নিঃশব্দে সে কেবল চেয়ে আছে কিরীটীর মুখের দিকে।
আমি জানি ছিল—কিরীটী বলতে থাকে, আর সে ঘনিষ্ঠতার কথা রাণীমা জানত, তাই না?
সুরতিয়া পূর্ববৎ নীরব।
এবার বল ওই সুধন্য কে?
আ—আমি জানি না বাবুজী!
জান—বল কে?
আ-আমি জানি না।
তুমি বলতে চাও তুমি জান না কেন রাণীমা অমন করে সুধন্য এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালেই তাকে টাকা দিতেন?
রাণীমা ওকে পেয়ার করতেন, তাই—
কিরীটী হেসে ফেলে, কি বললে পেয়ার!
হ্যাঁ
মিথ্যে কথা—ঝুট। উসসে রাণীমাকো বহুৎ নফরৎ থি।
নেহি বাবুজি-নেহি, সাচমুচ—রাণীমা—
শোন সুরতিয়া, তুমি যাই বল আমি জানি রাণীমা ঐ সুধন্যকে দুচক্ষে একেবারে দেখতে পারত না-বল, সত্যি কথা বল— রাণীমা কেন সুধন্যকে আমন করে টাকা দিতেন বল?
বিশ্বাস করুন, বাবুজী, আমি জানি না।
আমি কিন্তু জানি কেন রাণীমা ওকে টাকা দিতেন!
আ—আপনি জানেন? গলার স্বরে যেন একটা চাপা আতঙ্ক ফুটে ওঠে স্পষ্ট হয়ে সুরতিয়ার হঠাৎ।
তুমি বলছ রাণীমা সুধন্যকে পেয়ার করত—কিন্তু কেন? কি সম্পর্ক ছিল সুধন্যর সঙ্গে রাণীমার? কে ও রাণীমার?
কেউ না।
তবে?
কিন্তু বাবুজী—