গণেশ প্রথমে জয়ন্তবাবুকে ডাকতে গানের আসরে যায়—সেখানে খোঁজ না পেয়ে ফিরে আসে আবার বাড়ির মধ্যে। জয়ন্ত চৌধুরীর ঘরে যায়, তাকে ডাকাডাকি করে তোলে— যেহেতু জয়ন্ত চৌধুরী তখন ঘুমোচ্ছিল।
জয়ন্ত চৌধুরী এসে মিনিট পনেরো-কুড়ির মধ্যেই এই ঘরে ঢেকে এবং ঢুকে দেখতে পায়-চিত্রাঙ্গদা দেবী মৃত।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটা-ওই পনেরো মিনিট সময়ের মধ্যেই কোন একসময় হত্যাকারী এই ঘরে ঢুকে তার কাজ শেষ করে চলে গিয়েছে।
রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটা!
শেষের কথাটা কিরীটী মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করে কতকটা বুঝি স্বগতোক্তির মতই।
কিছু বলছেন মিস্টার রায়? জয়ন্ত চৌধুরী প্রশ্ন করে।
বলছি চিত্রাঙ্গদা দেবীকে সম্ভবত রাত সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটার মধ্যে কোন এক সময় হত্যাকারী পিছন দিক থেকে অতর্কিতে ছোরার দ্বারা আঘাত করে সরে পড়েছে বলেই আমার মনে হচ্ছে। অর্থাৎ সে সময় দোতলায় একমাত্র চিত্রাঙ্গদা দেবী তার ঘরে ও আপনি আপনার ঘরে ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তি ছিল না বাড়ির মধ্যে। কাজেই—
কি?
যদি অতর্কিতে আঘাত পেয়ে একটা চিৎকার করেও উঠে থাকেন সেই মুহূর্তে চিত্রাঙ্গদা দেবী, একমাত্র আপনি ছাড়া আর কারো কানে পৌঁছবার কথা নয়-কিন্তু আপনিও ঘুমিয়ে ছিলেন।
জয়ন্ত কোন জবাব দেয় না।
নিঃশব্দে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। কিরীটী কি তাকে সন্দেহ করছে নাকি! কিরীটী আবার বলে, গণেশ গানের আসরে আপনাকে খুঁজে না পেয়ে যখন ওপরে এসেছে, তখন আততায়ী তার কাজ শেষ করে চলে গিয়েছে। গণেশ কি চিত্রাঙ্গদার এই ঘরে আর ঢোকেনি? হয়েতো ঢুকেছিল-চুকে এই দৃশ্য দেখে ভয়ে তাড়াতাড়ি আপনার কাছে ছুটে যায়।
কিন্তু গণেশ তো—
বলেনি সে ধরণের কোন কথা জানি। আমিও সেই রকমই যে কিছু ঘটেছে তা বলছি না। আমি বলছি, ওই রকমও কিছু হয়ে থাকতে পারে মাত্র।
বাইরে দালানে ওই সময় ঘড়িতে ঢং করে রাত সাড়ে বারোটা ঘোষণা করল।
গানের আসর। তখনো পুরোদমে চলেছে। মধ্যরাত্রির স্তব্ধতায় এতদূর থেকেও গানের লাইনগুলো যেন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
কিরীটীর মনে হয়, কি বিচিত্র পরিবেশ!
বাড়ির একাংশে যখন সঙ্গীতের সুধা ঝরে পড়ছে, অন্য অংশে তখন বাড়ির কর্ত্রী নিহত হয়ে রক্তস্রোতে ভাসছেন!
জীবন ও মৃত্যু!
১১. চৌবেজী
গণেশ! কিরীটী ডাকে।
গণেশ নিঃশব্দে একপাশে ঘরের মধ্যেই তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। গণেশ কিরীটীর ডাকে ফিরে তোকাল তার মুখের দিকে!
তুমি একবার নীচে যাও, গানের আসর থেকে জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্র ও ফণীন্দ্রবাবুকে ডেকে নিয়ে এস।
কি বলব তাদের? গণেশ জিজ্ঞাসা করে।
কি বলবে? বল-বল-হ্যাঁ বল, তাদের বড়মার বিশেষ জরুরী ব্যাপার, তাদের ডাকছে। হ্যাঁ শোন, একসঙ্গে নয়, পাঁচ-ছ মিনিট পর পর এক একজনের কাছে গিয়ে কথাটা বলবে, বুঝলে?
আজ্ঞে।
যাও ওদের ডেকে দিয়ে সরকারমশাইকে ডেকে দেবে। সুরতিয়া, আপাতত তুমি এ ঘরে থাক।
গণেশ বের হয়ে গেল।
কিরীটী আবার জয়ন্তর দিকে ফিরে তাকাল।
মিস্টার চৌধুরী!
বলুন।
ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলুন পাশের ঘরে যাই, ওখানেই কথাবার্তা হবে। চলুন।
মৃতদেহ যেমন ছিল তেমনই পড়ে রইল, সুরতিয়াকে ঘরে রেখে দুজনে মধ্যবর্তী দরজার দিকে অগ্রসর হল।
ঘর ছেড়ে যাবার আগে কিরীটী আর একবার চিত্রাঙ্গদা দেবীর শয়ন—ঘরটার চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।
নিভাঁজ শয্যা-বোঝা গেল সেরাত্রে খাটের ওপরে বেচারী শয়নেরও আর সুযোগ পাননি। ঘরের মেঝেতে কেবল খাটের কাছে দামী পুরু একটা কর্পেট বিছানো, বাকি মেঝেটা এমনি-আ-ঢাকা।
এক কোণে একটা বিরাট দু-পাল্লার আলমারি-সেকেলে সেগুন কাঠের তৈরী এবং কারুকার্য করা। তার পাশেই একটা গোলাকার বেশ বড় সাইজের শ্বেতপাথরের টপ টেবিল—টেবিলের ওপরে নানা টুকিটাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
উল্টোদিকে ঘরের সংলগ্ন বাথরুম।
কিরীটী ইতিমধ্যে বাতিরুমটাতে পরীক্ষা করে দেখছিল। বাথরুমের দরজা, যেটার বাইরের ঘোরানো লোহার সিঁড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে, সেটা ভেতর থেকে বন্ধই ছিল। বাথরুমটাও বেশ প্রশস্ত। আগাগোড়া ইটালিয়ান গ্লেজটাইলের দেওয়াল-মেঝেও ইটালিয়ান মোজাকের। বাথটাব, শাওয়ার, বেসিন—সব ঝকঝকে তকতকে।
ঘরের মধ্যে শ্বেতপাথরের গোলাকার টেবিলটা ছাড়াও একটা মাঝারি আকারের টেবিল আছে। কিছু বই ও নানা ধরনের ফাইল খাতপত্র টেবিলের ওপরে সাজানো।
সামনে একটা দামী কুশন মোড়া চেয়ার। একটা আরাম-কেদারাও ধরের মধ্যে আছে। আর একটা লোহার দেওয়ালে গাঁথা সিন্দুক। সিন্দুকটার একেবারে গা থেকে শোবার খাটটা।
আগে আগে চলেছিল জয়ন্ত-পিছনে কিরীটী, হঠাৎ কিরীটীর নজরে পড়ে ঘরের মেঝেতে মধ্যবতী দরজার একেবারে গা থেকে কি একটা পড়ে আছে-চিকচিক করছে।
কিরীটী কুঁকে নীচু হয়ে জিনিসটা মেঝে থেকে তুলে নিল। রঙিন কাচের চুড়ির একটা ভাঙা টুকরো।
কি হল? জয়ন্ত ঘুরে দাঁড়ায়।
না, কিছু না। চলুন।
দুজনে এসে পাশের ঘরে ঢুকল।
সুধন্য একা একা ঘরের মধ্যে বসেছিল—ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকাল।
আমি নীচে যেতে পারি? সুধন্য জিজ্ঞাসা করে।
পালাবার চেষ্টা করবে না তো?
না।
তাহলে যাও। ডাকলেই যেন পাই।
হ্যাঁ, নীচে গেস্টরুমের পাশের ঘরেই আমি থাকব।
যাও তাহলে। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
সুধন্য ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মনে হল সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ওকে যেতে দিলেন মিস্টার রায়, যদি পালিয়ে যায়? জয়ন্ত চৌধুরী বলে কিরীটীকে।