কিরীটী চিন্তা করতে করতে অগ্রসর হয়, এত রাত্রে চিত্রাঙ্গদা দেবীর ঘরে কেন তার ডাক পড়ল!
জয়ন্ত চৌধুরী ডেকে পাঠিয়েছে তাকে।
আজ সন্ধ্যার সময় জয়ন্ত চৌধুরী একবার তার ঘরে এসেছিল, বলেছিল কাল সকালেই সে নাকি কলকাতা ফিরে যাবে।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে সেই যে প্রথম দিন। এখানে পৌঁছবার পর সন্ধ্যায়। তাঁর ঘরে আলাপ শুরু হতেই ঘরে সুধন্যর আবির্ভাব ঘটল এবং চিত্রাঙ্গদা দেবী একটু পরে ঘর ছেড়ে হঠাৎ চলে গেলেন, তারপর আর চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে কোন আলাপ বা কথাবাত হয়নি। যদিও গত দুদিন যাত্রার আসরে ও আজ সঙ্গীতের আসরে দূর থেকে তাঁকে সে দেখেছে।
সাধারণের সিঁড়িপথেই কিরীটী গণেশকে অনুসরণ করে দোতলায় গিয়ে হাজির হল একসময়। সিঁড়ির আলোতে ও বারান্দার উজ্জ্বল আলোয় সব কিছু চোখে পড়ে-নির্জন, একেবাবে খাঁ খাঁ করছে চারদিক।
দূর থেকে গানের সুর ভেসে আসছে।
বসবার ঘরের দিকে নয়, গণেশ চিত্রাঙ্গদার শয়নঘরের দিকেই এগিয়ে গেল—
কিরীটিও এগোয়।
দরজাটা ভেজানো ছিল।
গণেশ হঠাৎ ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে কিরীটীর দিকে চেয়ে নিম্নস্বরে বললে, ভেতরে যান, জয়ন্ত দাদাবাবু ভেতরেই আছেন।
কিরীটী দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে পা দিল।
ঘরের মধ্যেও আলো জ্বলছিল—এবং ঘরে পা দিয়ে সামনের দিকে ভূমিতলে দৃষ্টি পড়তেই কিরীটী যেন আচমকা নিজের অজ্ঞাতেই থমকে দাঁড়ল। তার গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বের হয়ে এল শুধু-তারপরই সে যেন বোবা হয়ে গেল।
ধবধবে সাদা মার্বেল পাথরের মসৃণ মেঝের ওপর পড়ে আছে চিত্রাঙ্গদার দেহটা। পরনে সেই সন্ধ্যার দুধ-গরদ থান। সাদা মার্বেল পাথরের মেঝের অনেকটা জায়গা ও পরনের দুধ-গরদ থান রক্তে একেবারে লাল-যেন রক্তস্রোতের মধ্যে ভাসছে একটি শ্বেতপদ্ম।
উপুড় হয়ে মেঝের ওপর পড়ে আছেন মুখ থুবড়ে চিত্রাঙ্গদা দেবী। ডান হাতটা সামনের দিকে ছড়ানো, বঁ হাতটা ভাঁজ করা বুকের কাছে।
মাথার কেশভার খানিকটা পিঠের ওপর পড়ে ও খানিকটা দুপাশে ছড়িয়ে আছে। আর অদূরে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত চৌধুরী।
দৃশ্যটা এমনি মর্মদ্ভদ ও আকস্মিক যে কিরীটী কয়েকটা মুহুর্ত বিহ্বল বোবাদৃষ্টিতে সামনের দিকে কেমন যেন অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে।
কোন শব্দই তার মুখ দিয়ে বের হয় না। তারপর একসময় নিজের সম্বিৎ ফিরে পেয়ে জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে এগিয়ে ভূপতিত রক্তাক্ত দেহটার সামনে কুঁকে পড়ে প্রথমে শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করে, যদিও ভূপতিত দেহটার দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পেরেছিল চিত্রাঙ্গদা দেবী আর বেঁচে নেই।
তবু একবার ক্ষণেকের জন্য ভূপতিত দেহটা পরীক্ষা করে ধীর ধীরে উঠে দাঁড়াল কিরীটী।
কখন জানতে পারলেন। আপনি মিস্টার চৌধুরী?
কিছুক্ষণ আগে ঘরে ঢুকেই। মৃদুকণ্ঠে বললে জয়ন্ত চৌধুরী।
কখন আপনি এ ঘরে এসেছেন?
এগারোটা বাজবার বোধ হয় মিনিট কয়েক আগে—কারণ ঘরে ঢুকে ওই দৃশ্য দেখবার একটু পরেই বারান্দার ঘড়িতে এগারোটা বেজেছিল। আমিও ঠিক আপনার মত প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে গেছলাম, মিস্টার রায়। কি করব বুঝতে পারিনি, তারপর হঠাৎ আপনার কথা মনে পড়ল—গণেশকে দ্বিয়ে আপনাকে ডাকতে পাঠাই।
গণেশ কোথায় ছিল?
গণেশ আমাকে ডাকতে গিয়েছিল।
আপনি কোথায় ছিলেন?
ঘরে। সন্ধ্যেবেলা থেকেই মাথাটা ধরেছিল, তাই দোতলায় নিজের ঘরে শুয়েছিলাম।
আপনি গানের আসরে যাননি?
না।
হুঁ। গণেশ আপনাকে ডাকতে গিয়েছিল কেন?
বড়মা ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে। শুয়ে শুয়ে বোধ হয় একটু তন্দ্ৰামত এসেছিল, গণেশের ডাকাডাকি ও দরজার গায়ে ধাক্কার শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ি।
তারপর?
আমার আসতে বোধ হয় মিনিট দশ বারো লেগে থাকবে। এসে দেখি, ঘরের দরজাটা ভেজানো। দরজা ঠেলে ঘরে পা দিয়েই দেখি ওই বীভৎস দৃশ্য। তখনো প্ৰাণটা একেবারে বের হয়ে যায়নি, মাঝে মাঝে মৃদু মৃদু আক্ষেপ করছেন যন্ত্রণায়। ঝুকে পড়ে ওঁর মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু বার দুই ঠোঁটটা কাঁপাল, তারপরেই সব শেষ হয়ে গেল।
গণেশ জানে ব্যাপারটা?
জানে।
তাকে ডাকুন তো একবার। কোথায় সে? বোধ হয় বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জয়ন্ত ডাকল অতঃপর, গণেশ-গণেশ—
গণেশ ভেতরে এল। তার দু চোখে জল। বেচারী কাঁদছিল তখনো।
০৯. কিরীটী ডাকল
গণেশ! কিরীটী ডাকল।
বাবুজী–
সব কথা আমাকে বল গণেশ, তোমাকে তোমার রাণীমা কেন জয়ন্তবাবুকে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন এবং কখন?
গণেশ কঁদতে কাঁদতে ধরা গলায় যা বললে, তার সারার্থ হচ্ছে ঃ গানের আসর থেকে আধঘণ্টাটাক আগে রাণীমা উঠে আসেন। এসে সুরতিয়াকে দিয়ে গণেশকে ডেকে পাঠান নীচের থেকে। গণেশ এলে তাকে বলেন জয়ন্তকে ডেকে আনতে। গণেশ প্রথমে ভেবেছিল, জয়ন্ত দাদাবাবু বুঝি নীচে গান শুনছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে খোঁজ করে না পেয়ে তাঁর ঘরে এসে তাকে ডাকে।
তুমি এই ঘরে এসেছিলে?
হ্যাঁ, ঘরে ঢুকে দেখি,-গণেশ বলে, রাণীমা জানলার কাছে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন।
তারপর?
রাণীমা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলেন জয়ন্ত দাদাবাবুকে ডেকে দিতে।
সুরতিয়া কোথায়? তাকে দেখছি না কেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।
কেন, সে তো রাণীমার কাছেই ছিল!
কোথায় গেল সুরতিয়া-দেখ তো। ডেকে আনো তাকে।
তাহলে বোধ হয় নীচে গেছে গান শুনতে। রাণীমা ফিরে এলে তো সে নীচে যেত। গান শুনতে।
যাও, দেখ-তাকে ডেকে আনো জলসা থেকে।
গণেশ চলে গেল।
মৃদু কণ্ঠে জয়ন্ত বলে, শেষ পর্যন্ত বড়মার আশঙ্কটাই সত্যি হল।